রেটিংটা করে দেবেন দিদি
ঘুম ভাঙলেই ওঁদের সঙ্গে দেখা। আমাদের রোজকার জীবনে নানারূপে আছেন ওঁরা। কখনও মিষ্টি মুখে, কখনও ঝুটঝামেলায় দিনগুলি কাটে ওঁদের সঙ্গে। সেই অম্লমধুর কথকতা এই কলমে।
ইদানীং ওদের সঙ্গে দেখা হওয়াটা আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। এর একটা বড় কারণ যে অতিমারী, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ২০১৯-এর শেষ পর্যন্ত, আমি নিজে অনলাইন খরিদ্দারি যতটুকু করেছি, তা হাতে গোনা। এখন সাঁড়াশি থেকে ওষুধ, সবই অনলাইনে কিনছি। এই যে ঘরের দুয়ারে দৈনন্দিন প্রয়োজনের সব সরঞ্জাম চাইলেই হাজির হয়ে যায়, তা নিঃসন্দেহে বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল অনলাইন শপিং কোম্পানিগুলির বদান্যতায়। তারা গত তিন বছরে পরিস্থিতির সুযোগ নিপুণভাবে নিয়ে, আমাদের কেনাকাটার অভ্যাস বদলে দিয়ে, তাদের ব্যবসাপাতি বিপুলহারে বাড়িয়ে ফেলেছে। এসব তথ্য অবশ্য এখন সকলেরই জানা।
যেটার জন্য এই ভূমিকা, এবার আসি সেই প্রসঙ্গে, অর্থাৎ, তাহাদের কথায়। আমাদের চাহিদামতো ঘরের দরজায় কোম্পানিগুলি তাদের পণ্য পৌঁছে দেয় যাদের মাধ্যমে, সেই ‘ডেলিভারি বয়’ তকমার মানুষদের নিয়েই আজকের প্রতিবেদন। সারা দেশ জুড়ে অসংখ্য তরুণ-তরুণী এখন এই পেশায়। মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় কম। তবে, আর বেশিদিন এই কম-বেশির আনুপাতিক হার থাকবে না। চাকরিবাকরি নেই। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে কষ্টসাধ্য কাজে কেউই আর পিছপা নয় আজ। কষ্টসাধ্য বলে ?! পিঠে বিশাল এক ভারি বোঝা নিয়ে সকাল ৭টা থেকেই পথে নেমে পড়ে ওরা। কাজের শুরুর সময়টা নির্দিষ্ট থাকলেও, শেষ হওয়ার কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই।
আমি আজকের পর্বে শুধু পোশাক-আশাক, বাসনপত্র ও অন্যান্য গৃহস্থালী সরঞ্জাম পৌঁছে দেয় যারা, তাদের কথা বলছি। আদতে এই তালিকায় যথার্থই ‘আলপিন টু এলিফ্যান্ট’ থাকে। ‘খাদ্যবস্তু’ ডেলিভারির ব্যাপারটা পরে কখনও পৃথকভাবে লিখবো। কারণ, দুটো কাজের পদ্ধতিগত কিছু পার্থক্য আছে। পরিশ্রম সাপেক্ষতার বিচারে পণ্য ডেলিভারি যারা করে, তাদের কাজটা অনেকবেশি কষ্টদায়ক। বিশেষত, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে তাদের যে দুরাবস্থা হয়, তা অবর্ণনীয়। গত দু’বছর ধরে চোখের সামনে দেখছি এই কষ্টের পরিমাণ। আমাদের খারাপ লাগলেও,ওরা নিরুপায়। যারা পুরোনো হয়ে গেছে, তারা এখন এসব তেমন গ্রাহ্য করে না। পেশাদারী কাজের স্বার্থে প্রকৃতির রোষ মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়ে ঘুম ভাঙা সকালে। নতুনদেরই মানিয়ে নিতে কষ্ট। পুরোনো হলে তাদেরও সয়ে যায়।
একটা কথা, এই কাজ যে শুধু পরিশ্রম সাপেক্ষ, তা কিন্তু নয়। যথেষ্ট মেধারও দরকার হয়। প্রথমে এরিয়া অনুসারে প্যাকেট বাছাই। তারপর লিস্টের ঠিকানা ও ল্যান্ডমার্ক দেখে সেই ঠিকানায় পৌঁছনো। তার আগে ফোনে গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আগাম জানিয়ে রাখা। এইসবই নিপুণ দক্ষতায় করতে হয় প্রতিটি ডেলিভারি বয়কে। এছাড়া, এ কাজে মাথা ঠান্ডা রাখা অত্যন্ত জরুরি। কমিউনিকেশন স্কিল তো চূড়ান্ত পর্যায়ে লাগে। বলা বাহুল্য, সংগত কারণেই সবার মধ্যে প্রতিটি গুণ সম পরিমাণে থাকে না। সবার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যে এক হবে না, সেটাই তো স্বাভাবিক। কেউ হয়তো অল্পেই অধৈর্য। কেউ আগাম না জানিয়েই বাড়ির দরজায় পৌঁছে যায়। এবার গ্রাহক হয়তো এমন কোনও কাজে ব্যস্ত, দৌড়ে আসতে পারছে না। এক্ষেত্রে কোম্পানি যতই মেসেজ পাঠাক, ডেলিভারি বয়ের পক্ষ থেকে আগে ফোন পাওয়াটা আবশ্যক। কারণ, সারাদিন নানা কাজে মেসেজ চোখ এড়িয়ে যেতেই পারে। অর্থাৎ, গ্রাহক এবং ডেলিভারি বয়ের মধ্যে একটা যোগাযোগ সবসময় থাকা জরুরি।
গত দু’তিন বছরে যাঁদের দেখলাম, তাঁদের মধ্যেকার তুল্যমূল্য বিচারেই এই বিষয়গুলো উপলব্ধি করেছি। যাঁরা দক্ষ ও অভিজ্ঞ, তারা গ্রাহকের পারিবারিক পরিস্থিতি বা সমস্যা–দুটোই বুঝে যায় এবং সেই প্রেক্ষিতেই নিজেদের কাজটা করে। সমস্যা হয় অনভিজ্ঞদের ক্ষেত্রে। একবার একটি ছেলে এক তীব্র শীতের সকালে আগাম না জানিয়ে চলে এসেছিল আমার বাড়ির দরজায়। খুব রেগে গেছিলাম। তখনও জানি না, ওদের এখন কাজের শিডিউল শুরু সকাল ৭টায়। কোনও কারণে মেসেজ মিস করে গেছি। ছেলেটিও বিরক্ত ! তার বক্তব্য, ফোন করে পায়নি সে আমায়। চিরন্তন নেটওয়ার্ক সমস্যা। কিছুটা বাকবিতন্ডা এবং ছেলেটির গোমড়া মুখে বিদায়। আমি দোনমনা করেও রেটিংয়ে খারাপ কিছু দিতে পারলাম না। মনে হলো, ও তো আমারও আগে ঘুম থেকে উঠেছে। সত্যি বলতে কী, এখানে, গ্রাহকদের ওপরেও কিছু দায়িত্ব বর্তায়। অর্ডার প্লেস করার পর ট্র্যাক রাখাটা গ্রাহকের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে আমি সেই দায়িত্ব পালন করিনি। অথচ, আমার নিজেরই এমন হয়েছে, খুব জরুরি কারণে শহরের বাইরে গেছি। ঘর তালাবন্ধ। ডেলিভারি কে নেবে ? ডেলিভারি বয়কে ফোন করে, তাঁকে পরিস্থিতি জানিয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছি।
শেষ করবো, একটি ছোট্ট অভিজ্ঞতা জানিয়ে। সেই সময় করোনার প্রকোপ একেবারে তীব্র। মাস্ক-স্যানিটাইজার অধ্যুষিত যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি সকলেই। তেমনই একদিন। খাঁ খাঁ দুপুরে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত এক তরুণ এলো ডেলিভারি নিয়ে। মুখে মাস্ক নেই। প্রথমে তো একচোট বকলাম তাকে। সে কাচুমাচু মুখে প্রথমেই বললো, “রিপোর্টে লিখবেন না দিদি। আর রেটিংয়েও…(তারপর মুখ নামিয়ে) কী করবো দিদি, মাথা ঠিক রাখতে পারি না। আমাদের এরিয়া বেড়ে গেছে অনেক। কিন্তু টাকা যে কে সেই !” চুপ হয়ে গেলাম। মনে হলো, যেটাই বলি, সাজানো লাগবে কানে। কর্মহীনতার সুযোগ কর্মদাতারা যুগ যুগ ধরেই নিয়ে চলে। তারপর,’একটু দাঁড়াও’ বলে ঘরে গিয়ে নিজের স্টক থেকে একটা মাস্ক এনে দিলাম তার হাতে। কৃতজ্ঞ হেসে, মাস্ক পরে চলে যেতে যেতে সে বলে যায়, “রেটিংটা করে দেবেন দিদি।”