শ্রোতার হৃদয়ে থাকবেন তিনি
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম প্রকাশিত হচ্ছে মাসে একবার। সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুমিত্রা সেনকে নিয়ে আজ ‘তবু অনন্ত জাগে’-র বিশেষ পর্ব। লিখেছেন অজন্তা চৌধুরী।
সেই সময়কার বাংলা গানের জগতের অগণিত জ্যোতিষ্কের মাঝে তিনি ছিলেন অন্যতম। নতুন বছর শুরুর সপ্তাহে তাঁর চিরবিদায় বাঙালিকে তাই স্বভাবতই বিধুর করে তুলল। একটি দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল বিস্ময়কর। রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী সুমিত্রা সেন ছিলেন স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনায় ভাস্বর। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গেই যবনিকা পড়ল একটি যুগের বা অধ্যায়ের। বাঙালির প্রাণপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের আকাশ জুড়ে তাঁর যে সফল বিচরণ, সেখানে তিনি ছিলেন বাঙালির বড় প্রিয় শিল্পী। বলা ভালো, সুমিত্রা সেন এভাবেই বাঙালি শ্রোতার হৃদয়ে থাকবেন চিরকাল।
পারিবারিক সূত্রেই সঙ্গীতের সান্নিধ্যে আসেন সুমিত্রা সেন। বাবা দর্শনের অধ্যাপক অতুলচন্দ্র দাশগুপ্ত। পরিবারে শিক্ষা ও সংস্কৃতির আবহ পেয়েছেন শৈশব থেকেই। গানের পাশাপাশি সেতার ও ভাস্কর্যে সমান আগ্রহ ছিল তাঁর। সুমিত্রা সেনের প্রাথমিক সঙ্গীতশিক্ষার শুরু তাঁর মায়ের কাছে। পরবর্তীতে তালিম নিয়েছেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বৈতানিক এবং গীতবিতানের মতো প্রথিতযশা শিক্ষাকেন্দ্রে। এখানে একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেলেও আধুনিক, পল্লীগীতি, ভজন, কীর্তন, নজরুলগীতি–সব ধরনের গানেই ছিল তাঁর অনায়াস ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ।
শিল্পী হিসেবে প্রথম পরিচিতি পান পাঁচের দশকের শুরুতে। তাঁর বিয়ের কিছুদিন আগেই রেকর্ডে প্রকাশিত হয় দুটি নজরুলগীতি–প্রথম গানটি ছিল ‘গোঠের রাখাল বলে দে রে’ ও দ্বিতীয়টি ‘বেদনার বেদীতলে’। এছাড়াও তখন বিভিন্ন ধারার বাংলা গান গেয়ে শ্রোতাদের প্রশংসা অর্জন করছিলেন তিনি। তার মধ্যে পালাগান বা বিয়ের গানও আছে। পরে অবশ্য রবীন্দ্রসঙ্গীতেই বিপুল খ্যাতি লাভ করেন সুমিত্রা সেন। এখনও অবধি ১৮৫টি রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বাজারে বেরিয়েছে সুমিত্রা সেনের। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ক্যাসেট ও সিডি।
একথা বলাই বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের গান অতলস্পর্শী। যেমন অগাধ তার ভান্ডার, তেমনই তার বৈচিত্র্যের ডালি। বাঙালির পরমাশ্রয় সেই রবীন্দ্রগানকে নিজস্ব অনুভব ও উপলব্ধির মেলবন্ধনে জীবন্ত করে তুলেছেন এক একজন শিল্পী। সুমিত্রা সেন তাঁদেরই একজন। রবীন্দ্রনাথের গানের যে অভিব্যক্তি, তা তাঁর ব্যতিক্রমী গায়নশৈলীতে হয়ে উঠত অনবদ্য। সরল ও অকৃত্রিম গায়কী ছিল তাঁর পরিবেশনের অন্যতম সম্পদ। তাঁর কণ্ঠে বাঙালি শ্রোতা কোনও দিন ভুলবে না যে গানগুলি–আমার সকল দুখের প্রদীপ, ঘরেতে ভ্রমর এল, সখী ভাবনা কাহারে বলে, ছিন্নপাতার সাজাই তরণী, ওলো সই ওলো সই, আজি বিজন ঘরে, চোখের আলোয় দেখেছিলেম, সেদিন দুজনে, আমি জেনেশুনে বিষ, এসো আমার ঘরে, আমি তোমার প্রেমে…এবং আরও অজস্র গান।
প্রায় ১৬টি বাংলা ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন তিনি। নায়িকাদের লিপে সেইসব গান চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে, সে কথা বলাই বাহুল্য। কে নেই নায়িকাদের তালিকায়–সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, মাধবী মুখোপাধ্যায়, অঞ্জনা ভৌমিক, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, নন্দিনী মালিয়া প্রমুখ। সবার লিপেই জনপ্রিয় হয়েছে তাঁর গান, যা বাংলা সঙ্গীত ও সিনেমার এক অন্যতম সম্পদ হয়ে আছে ও থাকবে। তাঁর সুমিষ্ট গায়নভঙ্গী আমাদের মুগ্ধ করেছে বারবার। সুদীর্ঘ সঙ্গীতজীবনে উস্তাদ আলি আকবর, পন্ডিত রবিশঙ্কর, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহ বহু কিংবদন্তি শিল্পী ও স্রষ্টার সঙ্গে কাজ করেছেন সুমিত্রা সেন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের সীমা অতিক্রম করে বিদেশেও ছড়িয়ে আছে সুমিত্রা সেনের অগণিত গুণমুগ্ধ ভক্ত ও ছাত্রছাত্রী।
সঙ্গীত জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি সাংসারিক দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলি সমান দক্ষতায় সামলেছেন সুমিত্রা সেন। সাংসারিক গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেও কীভাবে একজন প্রকৃত শিল্পী হয়ে ওঠা যায়, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি। সুমিত্রা সেন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, শিল্পী হতে গেলে কোন কিছুই ত্যাগের প্রয়োজন নেই। সংসার যেমন জীবনেরই একটি অঙ্গ, গানও তেমনই সাধনার এক অনুষঙ্গ। আর সেই বিশ্বাসেই তিনি গাইতে পেরেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, ঋতু গুহ, সাগর সেন, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো কালজয়ী রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের সঙ্গে। প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন প্রতিটি নিবেদনে। জীবন থেমে থাকে না। তাই এই বিদায় হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু, শিল্পীর মৃত্যু হয় না। তাঁরা যে বাস করেন আপামর মানুষের হৃদয়ে। সুমিত্রা সেন এভাবেই বেঁচে থাকবেন চিরকাল।