Monday, February 3, 2025
টলিউডলাইম-Light

সময়োপযোগী ও সাহসী প্রচেষ্টা

নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। এই বিভাগে মাঝে মাঝে আমরা ভিন্ন ভাষার ছবি নিয়েও আলোচনা রাখছি। আজ তেমনই একটি ছবি, সাঁওতালি ভাষায় নির্মিত ছবি ‘টর্টওয়াইজ আন্ডার দি আর্থ’ নিয়ে লিখেছেন নির্মল ধর

সাঁওতালি ভাষায় ছবি এর আগেও হয়েছে–দর্শন হাঁসদা, প্রান্তিক বসু, নিশা মুর্মুরা বানিয়েছেন। সম্প্রতি দেখলাম শিশির ঝা নির্মিত ‘টর্টওয়াইজ আন্ডার দি আর্থ’ (Tortoise under the earth)। ছবিটি গত কলকাতা ফিল্ম উৎসবে ‘rare indian language film’ বিভাগে দেখানো হয়। ছোট নাগপুর, সিংভুম, দলমা পাহাড় সন্নিকটে প্রকৃতির অপার উপহার সহ জঙ্গল-নদী ঘেরা কৃষি অঞ্চলে যে সাঁওতালি উপজাতির বাস, তাঁদের কথাই উঠে এসেছে এই ছবিতে। এই মানুষগুলির প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় শুধু নয়, ধর্ম-আধ্যাত্মিক ভাবনাতেও ঘিরে রয়েছে প্রকৃতির ছন্দ, নিজেদের ভাষায় একান্ত নিজস্ব লোকসঙ্গীত। ইদানীং তথাকথিত উন্নয়নের নামে সেই লোক সভ্যতাকেই ধ্বংসের চেষ্টা চলছে। ‘টর্টওয়াইজ আন্ডার দি আর্থ’ ছবির মূল বিষয় সেটাই।

A. Director Pic 300Dpi
সময়োপযোগী ও সাহসী প্রচেষ্টা 5

ছবির শুরুতেই দেখানো হয় একটি গ্রামের মধ্যে রয়েছে অতি প্রাচীন এক বটগাছ। তাকে ঘিরে আছে এক অপ্রাকৃত রহস্য। ওই গাছে নাকি অপদেবতা বাস করে। গ্রামে রটনা, ওই গাছের হাওয়া-মাটি বিষাক্ত। কত মানুষ মারা গেছে। ঝাড়ফুঁক করেও কিছু সুরাহা হয়নি। মাঝে মাঝে শহরের বাবুরা এসে বলেছেন, গাছের তলায় ইউরেনিয়ামের খনি আছে। ওই ধাতুর রেডিয়েশন থেকেই যত গণ্ডগোল! কিন্তু অশিক্ষিত গ্রামবাসী সেটা মানতে নারাজ। তাঁরা গাছটিকে পুজো করেন। তাঁদের বিশ্বাস, দেবতা মারাং বুরু এমনটা করতেই পারেন না।

কিন্তু একদিন দেখা যায় শহর থেকে আধুনিক ক্রেন, মাটিকাটার বিশাল যন্ত্রপাতি জড়ো হচ্ছে গ্রামে। সরকারি গাড়িতে ঘোষনা হচ্ছে–গ্রামের সব্বাই ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাও। সরকার তোমাদের পুনর্বাসন দেবে, নইলে বিপদ আসন্ন। কিন্তু গ্রামবাসীরা সেসব না মেনে প্রতিবাদ জানিয়ে নাচ-গান করেন মাঠ জুড়ে। তাঁদের দেবতা মারাংবুরুকে ডাকেন বিপদ থেকে উদ্ধার করতে! কিন্তু, পাহাড়-জঙ্গল প্রকৃতির স্রষ্টা নীরবই থাকেন। বাস্তব আসলে বড়ই কঠিন! একসময় দেখা যায়, সংসারের সামান্য সম্বলটুকু মাথায় নিয়ে পুরো গ্রামের মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে নিরুদ্দেশে যাত্রা করছেন সার বেঁধে। কোথায় যাবেন, তাঁরা জানেন না। ভবিষ্যত কী, সেটাও অজানা। প্রতিবাদের কোনও স্বর নেই। নির্বিবাদে সাত পুরুষের ভিটে-মাটি ছেড়ে পরিযায়ীতে পরিণত হয় এক উপজাতীয় দল!

A. Film Still 1
সময়োপযোগী ও সাহসী প্রচেষ্টা 6

বিষয় হিসেবে অবশ্যই খুবই সাম্প্রতিক, জ্বলন্ত বাস্তব! সারা ভারত জুড়েই একইভাবে চলছে প্রকৃতির বুকে লুকিয়ে থাকা সম্পদ আত্মসাৎ করার প্রক্রিয়া। সরকারি মদতে ব্যবসায়িক বহুজাতিক সংস্থাগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ গ্রাস ও লুণ্ঠন করছে! ভূমি ও বাস্তুহারা হচ্ছে সাধারণ মানুষ–বিশেষ করে জনজাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়! এখানেই প্রশ্ন ওঠে, এটাই কি তাহলে সত্যিকারের উন্নয়ন ? আবার এমন প্রশ্ন তুললে, গায়ে তকমা পড়ছে দেশদ্রোহীর। পরিচালক শিশির ঝা এমন একটি বিষয় নিয়ে সাঁওতালি ভাষায় ছবি বানানোর প্রয়াস নিয়েছেন–এটাই নিঃসন্দেহে অনেক সাহস ও প্রসংশার দাবিদার।

কিন্তু যদি তাঁর সিনেমা তৈরির একটু ব্যবহারিক শিক্ষা থাকত ! ঘটনা, গল্প সাজানোর কোনও চেষ্টাই নজরে পড়ল না! অথচ তাঁর ক্যামেরাম্যান (?) কী সব অসাধারণ লোকেশন পেয়েছেন! কী দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য তুলেছেন তাঁর ক্যামেরায়। নাচ-গানের দৃশ্যগুলিও পেশাদারী কোরিওগ্রাফির সাহায্য ছাড়াই কী অসাধারণ সুন্দর! চোখ ও মন জুড়িয়ে দেয়! এর সঙ্গে যদি সিনেমা ভাষার ন্যূনতম যোগাযোগ ঘটত, সত্যিই একটা ভালো ছবি দেখার আনন্দ পেতেন সব ধরনের দর্শক!

A. Film Still 2
সময়োপযোগী ও সাহসী প্রচেষ্টা 7

ফটোগ্রাফির পাশাপাশি ছবির আবহ এবং সঙ্গীতের আয়োজনে দুর্গাপ্রসাদ মূর্মুর লোকগানের ব্যবহার ছবির গায়ে অলঙ্কারের মতো! অভিনয় করেছেন ঝাড়খণ্ডের বুরুডি ও তালসা গ্রামের সাঁওতাল বাসিন্দারা। তাঁরা অভিনয় করতে জানেন না, সেই চেষ্টাও করেননি। বিশেষ করে জগর্নাথ বাস্কে, মুগলি বাস্কে যে যার নিজের মতো সংলাপ বলেছেন, নিজস্ব ভাষার বয়ানে ও উচ্চারণে। সেটাই যথেষ্ট! সব শেষে শিশির ঝায়ের এমন সাহসী প্রচেষ্টাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে উপায় নেই! নাই বা থাকল সিনেমার চলতি ভাষা বা ব্যাকরণ!