সুধীর মিশ্রের ‘তনাব’ কাশ্মীরের জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি
হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। আজ ‘তনাব’ নিয়ে লিখেছেন মৃণালিনী ঠাকুর।
গত সপ্তাহে এই বিভাগে যে সিরিজটি নিয়ে লিখি, তার বিষয় ছিল কাশ্মীর। এই সপ্তাহেও লিখতে গিয়ে যে ওয়েব সিরিজটা প্রথমেই নজরে পড়লো, সেও দেখলাম কাশ্মীর। আসলে, নানা কারণে কাশ্মীর ঘুরেফিরে সংবাদ শিরোনামে। সেই অনুষঙ্গেই ফিকশন, বিশেষত ওয়েব সিরিজ নির্মাতাদের ভাবাচ্ছে কাশ্মীর সমস্যা। ২০১৭-র পটভূমিতে বিন্যস্ত ‘তনাব’ হলো এমন এক সামাজিক রাজনৈতিক কাহিনি, যেখানে নিরন্তর ঝামেলা ও অশান্তি স্পেশাল টাস্ক গ্রুপ (এস টি জি) বনাম কাশ্মীর উপত্যকার বিদ্রোহী দলগুলি। এই একশন থ্রিলারে সন্ত্রাস, সন্ত্রাস দমনের পাশাপাশি কাশ্মীরের সাধারণ নাগরিকের জীবনযন্ত্রণাও দারুণভাবে উঠে এসেছে। তাঁদের যাপন থেকে শান্তি, সুস্থিতি বিষয়গুলি হারিয়ে গেছে চিরকালের মতো।
‘তনাব’ কথাটার অর্থ Stress, বাংলায় আমরা একে চাপ, দুশ্চিন্তা, অশান্তি, অস্থিরতা–অনেক রকম ভাবে ভাবতে বা বলতে পারি ! আদতে, কাশ্মীর কোথাও যেন এই শব্দগুলির সমার্থক হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, জোড়াতালি দিয়ে একটি ছেঁড়া বস্ত্রকে মেরামত করার চেষ্টা ঘুরেফিরে বিফলে যাচ্ছে। একটু টান (পড়ুন টেনশন তৈরি হলেই) পড়লেই আবার ছিঁড়ে যাচ্ছে সেই বস্ত্র। বিখ্যাত ইজরায়েলি সিরিজ ‘ফওদা’-র রিমেক হলো ‘তনাব’, যেখানে চরিত্রগুলির পরিচয় ও দেশকাল পৃথক হলেও বিষয় সাপেক্ষে চেতনায় একই রকম আবেগের অনুরণন তোলে। ফলত, সোনি লিভ-এ ‘তনাব’ শুরুর পর থেকেই ওয়েব দর্শকের আলোচনায়।
‘তনাব’ অনেক কারণেই ভাবায় আমাদের। শুধু বিষয়ের ভিত্তিতে নয়, আমরা যখন এখানে পরিচালক হিসেবে সুধীর মিশ্রের নামটা পাই, অনেকেই একটু নড়েচড়ে বসি। বলিউডে ভিন্ন ধারার ছবি নির্মাতাদের একজন তিনি। কাশ্মীর চিত্র সুধীরের বীক্ষণে যে একটি সঠিক মাত্রা পাবে, তা সহজেই অনুমেয়। এক্ষেত্রে সুধীরের যোগ্য সহযোগী হয়েছেন সিরিজের আর এক পরিচালক সচিন কৃষণ। এই সিরিজে অভিনয় করেছেন জারিনা ওয়াহাব, এম কে রায়না, রজত কাপুর, মানব ভিজ, আরবাজ খানের মতো অভিনেতা। এছাড়াও আছেন দানিশ হুসেন, একতা কাউল, সত্যদীপ মিশ্র, শশাঙ্ক অরোরা, সুমিত কাউল, সুখমনি সাদানা প্রমুখ। অ্যাপ্লজ এন্টারটেনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যানারে এই সিরিজ প্রযোজনা করেছেন সমীর নায়ার।
মোটামুটি সব মিডিয়াই ‘তনাব’ এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। একটি ইংরেজি দৈনিকে এক সাংবাদিক ‘তনাব’ এর সমালোচনায় যথার্থই লেখেন এটি হলো আদ্যন্ত টেনশনে টানটান এক হাড় কাঁপানো থ্রিলার। বিষয়ের প্রতি বিশ্বস্ত কাহিনি রচনা ও তার যথাযথ বিন্যাসে নির্মিত এই সিরিজের পর্বগুলি এই প্রতিবেদকও দেখেছেন প্রায় এক নিঃশ্বাসে। নির্দেশক সুধীর মিশ্রের উল্লেখ আগেই করেছি। তাঁর হাতে এই সময়ের সবচেয়ে বিতর্কিত কাশ্মীর সমস্যা পর্দায় রূপ পেয়েছে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সংবেদনশীল এক ভঙ্গিতে। প্রতি পর্বেই এটা বোঝা গেছে, সুধীর ও সচিন জানেন, তাঁরা কী বলতে চেয়েছেন।
অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি ও নিখুঁত ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ‘তনাব’ এর তীব্র অস্থিরতার দিকটিকে সঠিক মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। বিশেষ ভাবে বলতে হয় এর ডায়ালগের কথা। উপত্যকার মানুষের ভাষা ও সেটা বলার যে ভঙ্গি, সেটাকে নিখুঁত ধরেছে এই সিরিজ। চিত্রনাট্য রচনায় সনিষ্ঠ ঈশান ত্রিবেদী ও সুধীর মিশ্র। নিবিষ্ট গবেষনার ছাপ স্পষ্ট তাঁদের কাজে। কাঠামো শক্তিশালী হওয়ায় এমন এক স্পর্শকাতর বিষয়ের পরিবেশনা সঠিক গুরুত্বে ধরা দেয় দর্শক মননে। আপাতত ১২ পর্বের প্রথম সিজন স্ট্রিমিং হয়েছে।