Monday, February 3, 2025
দর্পণে জীবন

হিলিং ভিলেজ : এক স্বপ্নের অঙ্গীকার

জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে নিজেই সে নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।

যৌবন যেন বাধাহীন চলমান জীবনের প্রতীক। নিজের পথ সে নিজেই খুঁজে নেয়। প্রচলিত গতের বাইরে যাওয়াতেই আনন্দ তার। সফল কেরিয়ারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বনে-বাদারে-পাহাড়ের অখ্যাত এক-একটি গ্রামে ঘুরে বেড়ানো এমন যৌবনের গল্পই যেন প্রতিফলিত অনুপম, অরুণাভ আর ভিকির কথায়। কেমন করে একে অপরের সঙ্গে মিলে ওরা কাজ শুরু করলো, কেমন করেই বা ওদের সঙ্গে যোগ দিল আরও অনেকে–সেই কাহিনির সূত্র খুঁজতেই এক নিবিড় দিনে আমার চুইখিমের আস্তানায় একত্রিত হলাম আমরা। সেই সময় কিছুদিন ধরে গ্রামে আসা-যাওয়ার মাঝে প্রায়ই লোকের মুখে ওদের কাজকর্মের কথা শুনি। এই তরুণ দলটি সম্পর্কে আগ্রহ জন্মায় তখনই।

অনুপম পুরকায়স্থ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শিলংয়ের এই তরুণ তার প্রতিভার চর্চার মধ্য দিয়েই জীবনকে এক বর্ণময় যাপনে পরিণত করেছে ! তারুণ্যের সীমারেখার মধ্যেই সে পার করে ফেলেছে বহু চড়াই-উৎরাই। বারবার নিজেকে ভেঙেছে ও গড়েছে। কেমন সেই ভাঙাগড়ার কাহিনি, শুরুটা শুনুন তার নিজের মুখেই–”২০০৪-এ ইংরেজিতে অনার্স সহ গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর যোগ দিলাম মেঘালয় গার্ডিয়ান পত্রিকায়, একজন সাংবাদিক হিসেবে। একই সঙ্গে চললো স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ।” এরপর অনুপম চলে যায় দিল্লী। ২০০৯-এ এমবিএ। এমবিএ করার পরই বিজ্ঞাপন ও মার্কেটিং-এ শুরু হলো কেরিয়ার। কাজ করেন বহু নামী দামি ব্র্যান্ড নিয়ে। “একাধিক বিষয়,পণ্য ও ব্র্যান্ড নিয়ে কাজ করার পর ২০১২-তে খুললাম নিজের কোম্পানি। ভালোই চলছিল সব। মুম্বই গিয়ে ধোনির সঙ্গে শুটিং করার মতো অভিজ্ঞতাও হলো। ২০১৩-র আগস্ট পর্যন্ত এভাবেই চললো। তারপরই…!” থামে অনুপম।

Fb Img 1667665133451
হিলিং ভিলেজ : এক স্বপ্নের অঙ্গীকার 10

বাইরে অনেকক্ষণ কোনও গাছের ডালে এক নাম না জানা পাখি ডাকছে। রোদ্দুরমাখা সকাল ক্রমশ দুপুরের দিকে এগোচ্ছে। বাতাসে মৃদু হিমের পরশ। আমরা সবাই ভাসছিলাম এক অপূর্ব ভাবাবেগের স্রোতে। অনুপম, অরুণাভ, আমি, ভিকি বা কন্নড় তরুণ সাই সংকেত ! আদতে, যে ভাবনা আমাদের আলোড়িত করছিল, সেটা ওই গতের বাইরে চলার স্বপ্ন দেখা, চিরাচরিত যাপনরীতির বেড়া ভেঙে নতুন কিছু করার তাগিদ। এখানে প্রত্যেকের জীবনের গতিপথ পৃথক হওয়া সত্বেও কোথাও মিলেমিশে যাচ্ছিল।

সাল ২০১৩। বিস্তৃত কাজের জগৎ, সাফল্য সব পিছনে ফেলে অনুপমের ফেরা সংগীতের কাছে। সংগীত, আর একটু বিস্তারে বলা যায় মিউজিক, যার সঙ্গে তার গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেছে সেই ক্লাস সেভেন থেকে। “গান বরাবরই আমার সঙ্গী হয়েই ছিল। নিজের ব্যান্ডও তৈরি করেছিলাম। ২০১৩-র পর আর ওই কর্পোরেট দুনিয়ায় মন টিকলো না। ভিতরে কোথাও একটা ছটফটানি হচ্ছিল। সব ছেড়ে শিলং ফিরে এলাম। দু’মাস বাড়িতে চুপচাপ থাকার পর আবার বেরিয়ে পড়লাম। ৬/৭ মাস টানা ট্রাভেলের পর ফের শিলং। ফিরে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম এনআইএফটি-তে। ক্লাস করালাম। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিলে ওয়ার্কশপ করলাম। সে এক হইহই ব্যাপার। ২০১৪-১৫’য় আবার ছন্দ ভেঙে গড়া। বেরিয়ে পড়লাম গিটার নিয়ে পথে। এবার স্ট্রিট মিউজিক “–এক নিঃশ্বাসে বলে যায় অনুপম।

Fb Img 1667665128434
হিলিং ভিলেজ : এক স্বপ্নের অঙ্গীকার 11

আমাদের কথা হচ্ছিল মূলত বাংলাতেই। অনুপম, অরুণাভ বাঙালি। ভিকি নেপালি ভাষী হলেও বাংলা বোঝে। বেঙ্গালুরুর ছেলে সাই কিছুদিন হলো এই ত্রয়ীর সংস্পর্শে এসেছে। বাংলা বোঝে না সে। কিন্তু তাতে কি? সে দিব্যি নিজের মতো করে বুঝে নিচ্ছিল বাকিদের আবেগ ও অনুভব ! আর মিউজিকের ভাষা তো সর্বজনীন ! এছাড়া, মাঝে মাঝেই তাকে তর্জমা করে দিচ্ছিল অনুপমরা। স্ট্রিট মিউজিকের ব্যাপারটা বিদেশে বহুল প্রচলিত। এদেশের কিছু কিছু শহরে দেখা গেলেও সেই অর্থে বিষয়টা পেশাদারীভাবে সব মহলে স্বীকৃত নয়। এই প্রতিকূলতার বেড়াও ভাঙলো অনুপম। মুম্বই, কলকাতা, গোয়া, পন্ডিচেরিতে পথের ছন্দে ও সুরের মৌতাতে আসর জমিয়ে তোলার ফাঁকেই কোথাও অজান্তে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়ে গেল আজকের ‘হিলিং ভিলেজ’ ভাবনার স্বপ্নময় যাত্রার। অনুপমের কথায়, “পন্ডিচেরিতে অরোভিলে থাকাকালীনই এর দিশা পেলাম। মনে হলো, এই কাজটাই আমি করতে চাইছিলাম মনেপ্রাণে।”

এখানে একটা কথা বলার। ওরা তিনজনই মূলত কাজটা করছে। সাই পরে যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে। সাইয়ের মতো অনেকেই আছে, যারা সম্পূর্ণভাবে যুক্ত না হলেও, আসা-যাওয়া করে। আর উনিশ-বিশ সকলেরই যাত্রাপথ অভিষিক্ত কথা-সুর-তালের রসধারায়। যদিও মিউজিক এখানে নিছক কথা-সুর-তাল নয়। তারও অতিরিক্ত কিছু। সীমার মাঝে অসীমের খোঁজ। নদী-জঙ্গল-পাহাড়ের ক্যানভাসে নতুন যাপনের ছন্দ খুঁজে ফেরা। পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রামে মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে জাগরণের জয়গান রচনা।

এবার একটু সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক ওদের এই ‘হিলিং ভিলেজ’ আসলে কি, সেই সম্পর্কে। অভিনব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে। এযাবৎকাল এটাই দেখে এসেছি আমরা, সরকারি ছিটেফোঁটার বাইরে পাহাড়ের মানুষের জন্য কাজ করে কিছু এনজিও। ব্যক্তিগত স্তরে সহৃদয় মানুষজনের এগিয়ে যাওয়াও দেখেছি। তবে, তার সবটাই গ্রামের লোকজনকে অর্থসাহায্য করা। কখনও সখনও জামাকাপড়, ওষুধপত্র দান। এই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াটাকে কুর্নিশ জানিয়েও বলবো, এটা একটা সাময়িক সমাধান। অনেক ক্ষেত্রেই কিছুটা তাৎক্ষণিক আবেগপ্রসূত কর্মকাণ্ডও বলা যায়। কিন্তু এদের কাজটা একেবারেই আলাদা।

ওরা যখন যে গ্রামে কাজ করছে, তখন সেটাই হচ্ছে ওদের বসবাসের ঠিকানা। মানুষকে সচেতন করছে বিভিন্ন বিষয়ে। গ্রামের মানুষের নিজেদের যে শক্তি, সামর্থ, ক্ষমতা, প্রতিভা, গুণাগুণ–তাকেই হাতিয়ার করে কিভাবে এক স্বনির্ভর ও সম্মানজনক জীবন তারা যাপন করতে পারে, তা বোঝাচ্ছে ওরা। এই গ্রামগুলিতে রয়েছে অপরিসীম প্রাকৃতিক সম্পদ–জঙ্গলের গাছপালা থেকে ফসলের জমি। এর অর্থ চাষবাস ও গরু-ছাগল-মুরগি পালনের সুযোগ। এবার এগুলোই কতটা দক্ষতা, কৌশল, বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবে করা সম্ভব–সেই পাঠও পড়ানো হচ্ছে এই প্রজেক্টের মাধ্যমে। পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যরক্ষার দিকটাতেও সচেতন করা চলছে। রয়েছে অঞ্চলভিত্তিক শিল্পপ্রতিভার বিকাশ । কোথাও বাঁশের কাজ, কোথাও কাঠের। কেউ ভালো গান করেন, কেউ বা খেলাধুলায় তুখোড়। এই যাবতীয় গুণ ও পারিপার্শ্বিক অনুকূলতা নিয়ে কি করে এখানকার মানুষ লড়াই চালিয়ে যেতে পারে, এই ত্রয়ী সেই ম্যাজিকই পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে গ্রামের মানুষের দরবারে। যার জন্য বিশেষভাবে তৈরি হয়েছে শিক্ষামূলক ও সচেতন ট্রেনিং প্রোগ্রাম।

Fb Img 1667665255804
হিলিং ভিলেজ : এক স্বপ্নের অঙ্গীকার 12

প্রসঙ্গত, পর্যটন উত্তরবঙ্গের পাহাড়ী গ্রামগুলির অর্থনৈতিক উন্নতির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার বলা যায়। একে ঘিরেই অনুপমদের লক্ষ্য অঞ্চলের শিল্প, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যাবতীয় স্বাতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে তাকে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা। এ প্রসঙ্গে আবেগতাড়িত তিন তরুণের বক্তব্য, আমাদের মিশন হলো এই প্রকৃতি এবং প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা মানুষগুলির সহজ সরল জীবনদর্শন, তাদের নিজস্বতার রক্ষণাবেক্ষণ। আঞ্চলিক শিল্প, এখানকার চিরন্তন ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ। উন্নতির নামে, পশ্চিমী সভ্যতার প্রভাবযুক্ত তথাকথিত আধুনিকীকরণের দৌড়ে কিছুতেই যেন হারিয়ে না যায় এই গ্রাম-মানুষ-প্রকৃতির যুগ যুগ ধরে চলে আসা রীতি, বিশ্বাস, যাপনভাবনা ও চিরাচরিত ইতিহাস। বলা যায়, এটাই এই ‘হিলিং ভিলেজ’ প্রকল্পের মূলমন্ত্র !

গুয়াহাটির তরুণ অরুণাভ দাম। সিকিম মনিপাল থেকে বি টেক করার পর একটি সফল কেরিয়ার গড়ে তুলবে, এটাই ছিল তার পরিবারের ভাবনা। তবে, সে আর হবে কী করে ? এখানেও যে সেই নিয়ম ভাঙার খেলায় মেতে ওঠা। এখানেও বাঁধন ছেঁড়ার স্বপ্ন দেখা সংগীতের হাত ধরে। কলেজজীবন থেকেই গান গাওয়া, গান লেখা শুরু। “সেই পাথেয় সম্বল করেই গড়ে ফেললাম নিজের ব্যান্ড ‘বটল রকেটস’, মূলত গুয়াহাটিকে কেন্দ্র করে। তবে, সেখানেও খুব তৃপ্তি হলো না বলে, আবার নতুন ব্যান্ড, নাম ‘ফেলো সিমারস’। ২০১৬-তে তৈরি এই ব্যান্ড এখনও রয়েছে, তারা কাজ করে গুয়াহাটি ও বেঙ্গালুরুকে ঘিরে…”,জানায় অরুণাভ।

গুয়াহাটি ও বেঙ্গালুরুতে তার ব্যান্ড। সেক্ষেত্রে এখানে  উত্তরবঙ্গের এই প্রত্যন্ত গ্রামে সে এলো কী করে ? কি করে জড়ালো ‘হিলিং ভিলেজ’এর সঙ্গে ? শুনুন তার মুখেই–”২০১৬’র পর গান ছাড়াও আরও অন্যান্য কাজে ছড়িয়ে দিলাম নিজেকে। মেতে উঠলাম আমার আর এক খুব পছন্দের সৃষ্টিশীল কাজ তথ্যচিত্র নির্মাণে। তখনই ‘চক্রশিলা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি’র উপর তথ্যচিত্র বানাতে গিয়ে আশপাশের গ্রামগুলো ঘুরে দেখার সুযোগ হলো। সেখান থেকেই এই ‘হিলিং ভিলেজ’ ভাবনার শরিক হওয়া, বলা যায়।”

গ্রামের জীবন ও প্রকৃতি, তার সঙ্গে সংগীতের নানা রং মিলে যে অনুভব, অনেকটাই আচ্ছন্ন করে ফেললো অরুণাভকে। সেই আচ্ছন্নতা নিয়েই ২০১৭ সালে যাত্রা অরুণাচল প্রদেশে। সেখানে দু’মাসের একটা প্রোজেক্ট করতে গিয়ে অভিজ্ঞতায় লাগলো আরও কিছু নতুন রং। সেখানকার আদি অধিবাসীদের মধ্যে থেকে গবেষণার কাজটা করা, শিল্প ও শিল্পীনির্ভর একটা চর্চা। সুযোগ ঘটলো তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ইত্যাদির ফাঁকে সারা দেশ থেকে আসা সৃজনশীল মানুষদের সংস্পর্শে যাবার। “সবার সান্নিধ্য, সহায়তা ও জ্ঞানভান্ডারকে কাজে লাগিয়ে একটি আর্কাইভ বানাচ্ছি ওখানে। এটা একটা স্বাধীনভাবে করা গবেষণালব্ধ কাজ। খুব আকর্ষণীয় ও তৃপ্তিদায়ক একটা জার্নি বলতে পারি একে”–জানায় অরুণাভ।

দুপুরের রোদ্দুরে এখন পড়ন্ত বেলার রং। কোথা দিয়ে সময় পালিয়ে যাচ্ছে, কে জানে ! ঘরের ভিতর থেকেই বাইরে যতটুকু দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়শ্রেণী। সেখানে একটু পড়েই ঢলে পড়া সূর্য মাখিয়ে দেবে নরম আলো। এরপর আমরা ভিকির কথা শুনবো। তার আগে আবার অনুপম। সে বলে, “মিউজিক নিয়ে নানা সৃষ্টিশীল ও পরীক্ষামূলক কাজ করতে করতেই সাউন্ড থেরাপির বিষয়টি উন্মোচিত হয় আমার সামনে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে প্রোজেক্টও করলাম কয়েকটি। এই সময়েই রাজ বসুর সঙ্গে পরিচয়। সেটা ২০১৯। পরিচয়ের পর উনি আমাদের স্বপ্ন ও ভাবনার কথা জেনে খুব উৎসাহ দিলেন। আমরা  চুইখিমে চলে এলাম। সে সময় অবশ্য অরুণাভ বা ভিকি ছিল না। সেইসময় যারা এসেছিল, তাদের মধ্যে আমিই স্থায়ীভাবে থেকে গেলাম। বাকিরা এখন আসাযাওয়া করে।” কাজে বা না-কাজে বৈচিত্রের বিচরণ সেরে অরুণাভও একদিন এসে পৌঁছয় চুইখিম।

Fb Img 1667665279245
হিলিং ভিলেজ : এক স্বপ্নের অঙ্গীকার 13

পরের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ছোট্ট করে রাজ বসুর পরিচয়। উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের পর্যটনশিল্পে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব তিনি। আমার চুইখিমের আস্তানাও তাঁরই আনুকূল্যে। এই তরুণদেরও তিনিই চুইখিম টেনে এনেছেন বুঝলাম। এবার ভিকির কথা। নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্প থেকে কোন মন্ত্রবলে বেঁচে ফিরেছে জানে না সে ! তবে, এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, ‘হিলিং ভিলেজ’ প্রোজেক্টে কাজ করা তার ভবিতব্য ছিল। হয়তো সেইজন্যই…!

ভিকি শর্মা। না, নেপাল তার জন্মস্থান নয়। ভিকির জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গের সামসিং ফাঁড়ি। বড় সুন্দর অরণ্যের গা ঘেষা সেই গ্রাম। প্রথমে গরুবাথান, তারপর দার্জিলিংয়ের স্কুলে পড়াশোনা ভিকির। ২০১৩-য় উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সে। পড়াশোনার বিষয় বিজ্ঞান। কিন্তু প্রবল আগ্রহ ফটোগ্রাফিতে। সেই ফটোগ্রাফির সূত্রেই রাজ বসুর সঙ্গে আলাপ। সে জানায়, “রুরাল ট্যুরিজম নিয়ে ওয়ার্কশপ করছিলেন রাজ স্যর তখন দার্জিলিংয়ে। আমি সেখানে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেলাম আমার দাদার মাধ্যমে।” তখন ওইটুকুই। সদ্য কিশোর ভিকি তখনও জানে না, সেই পরিচয় আবার পল্লবিত হবে কোনও একদিন। এরই মধ্যে ঘটলো অন্যকিছু। ২০১৪’য় সদ্য কৈশোর পার হওয়া ভিকি বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গেল নেপাল। সেখানে রামেছাপ বলে এক প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে পড়ানো শুরু করলো সে।

“লক্ষ্য করলাম, গ্রামটিতে শিক্ষাব্যবস্থা চরম অন্ধকারে। আমি ওদের ইংরেজি, বিজ্ঞান, অঙ্কের পাঠ দেওয়া শুরু করলাম”–জানায় সংবেদনশীল এই নেপালি তরুণ। প্রসঙ্গত, ওই গ্রামে বসবাসকারী বেশিরভাগ পরিবারই  ভূমিপুত্র নয়। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছে। সারা বিশ্বেই ভূমিহীন মানুষের ভাগ্যের আকাশ জুড়ে এই বিতারণের খেলা চলে। শুধুই নতুন করে জীবন প্রতিষ্ঠার লড়াই। তারই মধ্যে বাচ্চাদের শিক্ষা, তাদের পেশাদারি জীবনের জন্য তৈরি করে দেওয়া। এলাকার একমাত্র স্কুল থোসে মডেল স্কুলে এভাবেই যুক্ত হয়ে গেল ভিকি। তারপরই এল সেই ভয়াবহ দিন। নেপালের ভূমিকম্প ও সেই বাবদ ক্ষয়ক্ষতি সেসময় আন্তর্জাতিক খবরে পরিণত। বাকিটা শুনবো ভিকির মুখে, “১১দিন সম্পূর্ণ যোগাযোগ শূন্য। আশ্রয় নিয়েছি রিলিফ ক্যাম্পে। নেপালে নিজের মতো করে যে জায়গাটা তৈরি করেছিলাম, তা এই ভূমিকম্প সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দিল। মন ভেঙে গেল একেবারে। একটাই শান্তি, বেঁচে আছি। বাড়ির জন্য খুব টান অনুভব করলাম। নেপাল থেকে ফিরলাম বাড়িতে।”

জীবন বাঁচামরার চিত্রনাট্যে সব শিখিয়ে দেয়। যে পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে চলে গিয়েছিল ভিকি, সেই পড়াশোনার গুরুত্ব এবার বুঝলো সে। পড়াশোনা শেষ করার তাগিদেই এরপর যাওয়া সিকিমে। ফটোগ্রাফি অবশ্য বরাবর তার সঙ্গী হয়ে ছিল। “সঙ্গে একটা চাকরিও করলাম, দায়িত্বপূর্ণ পদেই। প্রচুর ট্রাভেলও করলাম। শেষে আবার চাকরির ওই কর্পোরেট পরিবেশে হাঁসফাঁস লাগলো। ২০১৭-তে সব ছেড়ে পুরোপুরি ফটোগ্রাফিতে মনোনিবেশ”–হাসতে হাসতে জানায় ভিকি। মূলত দাদার ট্রাভেল সংস্থার হয়ে ফটোগ্রাফির কাজ করতে করতেই গ্রাম ও গ্রাম্য পর্যটন বিষয়ে আগ্রহ জমে ওঠে ভিকির মধ্যে। ২০১৯-এ এক উৎসবে অনুপমের সঙ্গে আলাপ ও চুইখিম চলে আসা।

ভিলেজ ট্যুরিজম থেকে হিলিং ভিলেজ–কিভাবে ঘটে কাজের ধারার এই পরিবর্তন ? এটা বোঝার জন্য আমাদের আবার কিছুটা অরুণাভর কথা শুনতে হবে–”প্রথম যখন চুইখিম আসি, তখন মনে হয়েছিল এদের কাজের পুরোটাই পর্যটনকেন্দ্রিক। এটা আমাকে খুব একটা টানছিল না। মনে হচ্ছিল এভাবে বৃহত্তর স্বার্থে কিছু করা যাবে না। মডেল ভিলেজের ভাবনাটাও আমার মতে খুবই সীমাবদ্ধ! শুধু একটা গ্রামকে সুন্দর বা স্বনির্ভর করে কতজনকে সত্যি ভালো থাকার পাঠ দিতে পারবো আমরা ? তা সত্ত্বেও আমি অনুপমের সঙ্গে সংযুক্ত হলাম। বলতে পারি, এই সংযুক্তি ছিল হিলিং ভিলেজের গ্রাউন্ড ওয়ার্ক।” 

চুইখিম থাকাকালীন ওদের গ্রাউন্ড ওয়ার্ক আমিও দেখেছি। শিক্ষা, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট থেকে এলাকার শিশু-কিশোরদের নিয়ে নিয়মিত সংগীতচর্চা। এখানে একটি বৌদ্ধমন্দিরও স্থাপন করেছে ওরা। এতে একদিকে লোকজনের মধ্যে একটা সুন্দর, সুসমঞ্জস্য, নিয়মানুবর্তিতা তৈরি হচ্ছে। আর পর্যটন আকর্ষণের ক্ষেত্রেও এর উপযোগিতা অনস্বীকার্য। সবথেকে বড় কাজটা ওরা করেছে চুইখিম মাইন জুনিয়র হাইস্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। স্কুলের পড়াশোনার উন্নতি কিভাবে এখানকার যাবতীয় প্রতিকূলতার মধ্যেও করা যায়, তার একটি বিজ্ঞানসম্মত রূপরেখা তৈরি করেছে অনুপমরা। পড়ানোর কাজও চলছে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে বলেই প্রত্যাশা ওদের।

এবার ছোট্ট করে সাই সংকেতের কথা। বেঙ্গালুরুর এই তরুণের অনুপমদের ‘হিলিং ভিলেজ’ প্রোজেক্টে যুক্ত হওয়া সত্যি অভিনব। সদিচ্ছার ব্যাপারটা আসলে কোনও ভৌগলিক সীমা মানে না। পেশায় সে একজন আই আই টি ইঞ্জিনিয়র। গ্র্যাজুয়েশনের পর দু’বছর চাকরি করে বেঙ্গালুরুর একটি কোম্পানিতে। ২০১৯-এ এম টেক-এর ক্লাস শুরু। এদিকে চাকরি করাকালীন কর্পোরেট আবহ তার মধ্যেও সেই দমবন্ধকর অনুভূতি সৃষ্টি করে। এরইমধ্যে কোদাইকানালের একটি কৃষিফার্মে অর্গানিক ফার্মিং পদ্ধতিতে চাষবাস দেখে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ হয় সাই। বলা যায় সেটাই তার ‘হিলিং ভিলেজ’ প্রোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার টার্নিং পয়েন্ট। যদি এইসব কর্পোরেট চাকরি না-ই করবে, তাহলে এম টেক পড়ে কি হবে ? অতএব, বাড়িতে পড়া ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় সে। এতে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে বাড়িতে, বোঝাই যায় ! আমরা সকলেই উনিশ-বিশ এই গৃহযুদ্ধ সামলেছি–হাসতে হাসতে জানায় ওরা চারজনই। যাই হোক, কার্যকারণে কালিম্পং চলে আসে সাই। সেখানেই অনুপমের সঙ্গে দেখা ও এই প্রোজেক্টে যুক্ত হওয়া।

সবশেষে যেকথা বলার, ওদের এই কাজ বিশেষ কোনও অঞ্চল ভিত্তিতে সীমাবদ্ধ নয়। নয় সেই চির পুরাতন কিছু মানুষের জোট বন্ধনের সিলেবাস। একটা সময় যেভাবে ‘হিলিং ভিলেজ’ প্রোজেক্ট রূপায়নের কাজকে ঘিরে একত্রিত হয় ওরা, এখন বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পৃথক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সেই কাজেই মগ্ন এই তরুণের দল। কেউ হিমাচল তো কেউ উত্তরবঙ্গের গরুবাথান। পারস্পরিক যোগাযোগ ক্ষুন্ন না করেও কাজকে বিচিত্র পথগামী করেছে ওরা। পাহাড়ের গ্রামগুলোতে আবহমানকাল ধরে যে সমস্যাগুলো চলে আসছে, তার গভীরে গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করছে। কিছুটা অবহেলা ও বঞ্চনার কারণে পিছিয়ে থাকা। কিছুটা নিজেদের চাওয়াপাওয়া বা প্রাপ্য বুঝে না নেবার আলস্য। প্রজন্মগতভাবে এই রোগ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে পাহাড়ের গ্রামীন মানুষকে। রোগের উৎস খুঁজে বের করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তার জন্য যা যা করণীয় করছে এই তরুণ তুর্কির দল। নিজেদের বেঁচে থাকার রসদও জোগাড় করছে এই কাজের মাধ্যমেই।