উৎসব যায় উৎসব আসে…
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে জীবন নিজেই নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।
এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার…!
এমন অন্ধকারে আচ্ছন্ন প্রভাত দেখাটাই এখন অভ্যাস আমাদের। কিন্তু তাতে কি আসে যায় ? এই যে এত উৎসবের ঘটাপটা–তার মধ্যে একবারও কী আমরা মনে করেছি সেই মানুষগুলোর কথা, যাঁরা দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে অক্ষম, তাঁদের অবস্থা ? রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা ক্লাব সংস্কৃতির কল্যাণে পুজোর বাজেট এখন কোটির ঘর ছাড়িয়েছে। এই যে কয়েকদিন পর আসছে দীপাবলি উৎসব, সেখানে শুধু বাজি ফাটিয়ে এবং পুড়িয়ে উড়িয়ে দেওয়া হবে কোটি কোটি টাকা। এই উল্লাস, এই কোটি টাকার উৎসব কাদের জন্য? রাজ্যের অগণিত বেকার তরুণ ছেলেমেয়ে এই মুহূর্তে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে চূড়ান্ত হতাশ। কে ভাববে তাঁদের কথা ?
আমার বাবা একজন নিষ্ঠাবান সমাজকর্মী ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সূত্রে বহু বছর জেলে কাটিয়েছেন। পরবর্তীতে বাম আন্দোলনে যুক্ত হন। তারও পরে রাজনীতি ছেড়ে শুধুই সামাজিক কাজকর্মে নিজেকে যুক্ত রাখেন। কারণ আজকের রাজনৈতিক ভণ্ডামির নগ্ন চেহারাটা অনেক আগেই দেখতে পেয়েছিলেন। জীবনের শেষ দিকে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের লোভী, অসৎ চেহারাটা দেখে সর্বক্ষণ যন্ত্রনায় ছটফট করতেন। বলতেন দেশকে তো স্বাধীন করতে পারলাম না। ব্রিটিশ গেল। এল দেশীয় অত্যাচারী কায়েমী স্বার্থপর শাসক। মানুষের ভালো হওয়ার তো কোনও লক্ষণই দেখছি না। ‘কেমন আছেন’ এই প্রশ্নের জবাবে একটাই উত্তর দিতেন, দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছি। এটা কি বাঁচা ?
আমার বাবা একা নন, রাজনীতি বা সামাজিক কাজকর্মে নীতি ও আদর্শের পথে যাঁরা চলতেন, একটা সময়ের পর দেশ গঠনের স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় তাঁরা অনেকেই জর্জরিত হয়েছেন। চলে গেছেন এই যন্ত্রনা, হাহাকার নিয়েই। ওঁদের তবু কিছু অবদান ছিল। কিছু তৃপ্তির অবকাশ ঘটেছিল। আমরা কি করছি ? ঘুম থেকে উঠে ফেসবুক আপডেট দেখছি। কোনও ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদের ঝড় তুলছি। বড় বড় কথা বলছি। চুলচেরা বিশ্লেষণ করছি। উচিত-অনুচিতের ব্যাখ্যা করছি। কিছু ভালো লাগলে শেয়ার করছি। নিজের পোস্টে লোকজন লাইক দিলে চূড়ান্ত আত্মশ্লাঘা অনুভব করছি। তারপরই ব্যস্ত হয়ে পড়ছি নিজের যাপনে। যেটা ওই দিনগত পাপক্ষয়। ভুল বললাম–আমরা পাপক্ষয় নয়, সঞ্চয় করছি।
কারণ আমরা কিছু করছি না। শিশুনিগ্রহ, নারীর ওপর অত্যাচার, নারী-পুরুষ নির্বিচারে হত্যা, অভাবী কৃষকের আত্মহত্যা, অবহেলিত ও নিপীড়িত শ্রমিকের যন্ত্রনা, সাধারণ মানুষের জীবনে রাজনৈতিক নোংরামির ভয়াবহ প্রভাব এইসবই দেখে চলেছি। নিষ্ক্রিয়ভাবে শুধু দেখছি। অসহায় অবলা পশুর ওপর অত্যাচার সেটাও দেখছি নিরন্তর। সীমান্তে দিনের পর দিন জওয়ান মরছে, দেশের মধ্যে সৎ পুলিশ মরছে। রাজনৈতিক হিংসার বলি হয়ে তরুণ প্রজন্ম মরছে। আমরা দেখে যাচ্ছি। আমাদের দিনযাপনে কোথাও কোনও ছেদ পড়ছে না। উৎসবের মরশুমে মেতে উঠছি মেকি আনন্দের উপকরণে। কারণ, প্রকৃত আনন্দ অধরা। যে উৎসবে ও আনন্দে সবার ভাগ মেলে না, সেটা প্রকৃত অর্থে কখনোই সার্থক হতে পারে না।
নিজেদের কি বলবো ? স্বার্থপর, ভন্ড, আত্মকেন্দ্রিক, ভীরু ? মনে হয় তাই। এটাই আমরা। আয়নায় নিজেকে দেখলে আমার অন্তত এই অনুভূতিটাই হচ্ছে। কিছুদিন উত্তরবঙ্গের পাহাড়ের এক প্রত্যন্ত গ্রামে থাকা ও সেখানকার একটি স্কুলের জন্য কাজ করতে গিয়ে দেখলাম কতটা অক্ষম আমি। কিছুই করতে পারলাম না। কিছু মানুষের ব্যক্তিস্বার্থ সমগ্রের অগ্রগতির পথে বাধা হবে, এটাই এখানকার রীতি। অতএব পিঠটান। গ্রামের সঙ্গে, স্কুলের সঙ্গে আমার প্রানের টান রচিত হয়ে গেছে। ওখানে গেলেই উজার করা ভালোবাসা পাই। কিন্তু আমি তো ওদের সার্বিক উন্নতির ক্ষেত্রে কিছুই করতে পারলাম না। একা একা করা যায়ও না আসলে। বোধহয় এটাও এক অক্ষমতা। আজ মানুষের জন্য কিছু করতে হলেও বোধহয় এখনকার নীতিহীন রাজনৈতিক সমাজসেবার কায়েমী প্যাটার্নটা অনুসরণ করতে হবে। নাহলে ঘরে বসে থাকো।
সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে প্রবল ধাক্কা খেল ২০১৪ টেট চাকরি প্রার্থীদের ধর্না আন্দোলন। গান্ধীমূর্তির পাদদেশে ধর্নায় সময়সীমা বাড়ানোর অনুমতি চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন টেট চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ। কিন্তু তাঁদের সেই আবেদনে সাড়া দিল না হাইকোর্ট। আইনি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমাদের কিই বা বলার থাকতে পারে ? তবে, প্রতিবাদ যে হয়, আজও সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনে নামে তরুণ প্রজন্ম–এই ঘটনা তাঁর প্রমাণ। এই কারণেই, হাজারো হতাশার মাঝেই আমি তরুণদের ওপর এখনও বিশ্বাস রাখি। আশা করি, তারা একটু ভিন্নপথে হাঁটবে। একত্রিত হবে তারা মানবিক মূল্যবোধের সামিয়ানার নিচে।
এমনটা না হলে দেশ বাঁচবে না। আগামী প্রজন্ম পথ করে নিক, এই সবাইকে নিয়ে বাঁচার প্রেরণায়। যদিও জানি, আমরা ওদের কিছুই দিতে পারিনি। আমাদের আদর্শ নেই, নীতি নেই, বিশ্বাস নেই। আছে শুধু বুলি। আছে কথার ফুলঝুরি। কিন্তু, কথায় আর চিড়ে ভিজবে না, এটাও উপলব্ধি করেছি। কারণ, কথারা এখন মিথ্যে হয়ে গেছে। আমার ভিতরের এই যে এত কথা, এও শুধু নিজের ভিতরের হারিয়ে যাওয়া আত্মাকে শেষবারের মতো খোঁজার চেষ্টায়। এই প্রশ্নের আলোড়নে, আমরা আদৌ বেঁচে আছি তো ??