প্রমিতার উত্তরণের গতি অব্যাহত
‘পরিচয়’-এর পর ‘প্রবাহ’
সিনেমা ওঁদের প্যাশন। প্রতিভা, মেধা, দক্ষতা আর নতুন নতুন ভাবনার আলিঙ্গনে বিচিত্র পথগামী ওঁরা। কেউ পূর্ণদৈর্ঘের ছবি নির্মাণে ব্যস্ত, কেউ তথ্যচিত্র বা ছোট ছবি। কখনও স্বাধীনভাবে, কখনও সামান্য বিনিয়োগ―স্বপ্নের কারিগররা ব্যস্ত তাঁদের নিজের ভুবনে। এইসব সিনেমা পরিচালক ও তাঁদের কাজ নিয়েই এই বিভাগ। আজ প্রমিতা ভৌমিক। লিখেছেন অজন্তা সিনহা
মাধবী মুখোপাধ্যায়ের মতো কিংবদন্তী অভিনেত্রীকে নিয়ে কাজ করছেন পরিচালক প্রমিতা ভৌমিক। খবরটা জানার পরই প্রবল কৌতূহল জাগে। প্রবীণ এই অভিনেত্রী একদা সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা রূপে পৃথক এক পরিচিতি পান। পাশাপাশি তিনি কাজ করেছেন মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, পূর্ণেন্দু পত্রী, তপন সিংহ প্রমুখের মতো পরিচালকের সঙ্গে। দীর্ঘ কেরিয়ারে মাধবী নতুনদের সঙ্গে একেবারেই কাজ করেননি, সেটা হয়তো নয়। তবে তুলনায় কম। এক্ষেত্রে প্রমিতার প্রস্তাবে ওঁর রাজি হয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে আলাদা উল্লেখের দাবীদার। জানা গেল, এখানেও প্রমিতার লেখনী প্রথম ম্যাজিকটা তৈরি করে, তাঁর প্রথম ছবি ‘পরিচয়’-এর মতোই। তাই মাধবী মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রবাহ’-এ যাওয়ার আগে আমাদের ‘পরিচয়’ প্রসঙ্গে জানতে হবে।
প্রসঙ্গত, বলে দেওয়া ভালো–এর আগে একটি তথ্যচিত্র ও একটি পোয়েট্রি ফিল্ম বানিয়েছেন প্রমিতা। ‘পরিচয়’ তাঁর প্রথম স্বল্পদৈর্ঘের ছবি। আর প্রথম কাজেই নিজের স্বতন্ত্র ভাবনার পরিচয় রাখেন পরিচালক তিনি। সিনেমা নিয়ে তাঁর স্বপ্ন, পথচলা প্রতি ক্ষেত্রেই প্রমিতা জানতেন কী তাঁর চাওয়া। তাঁর পরিচালিত ছবি প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে এটাই আমার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে মনে হলো। ভালো চাকরি, শিক্ষকতার স্থায়ী পেশা ছেড়ে সিনেমা তৈরির ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বেছে নেওয়া একজন তরুণীর পক্ষে আমাদের সমাজে আজও খুব সহজ নয়। সম্ভবত, সেই বোধ, চেতনা, মনন ও বিশ্বাসের জায়গা থেকেই নারীকেন্দ্রিক ছবি নির্মাণেই প্রমিতার আগ্রহ চোখে পড়ে।
তাঁর প্রথম ছবি ‘পরিচয়’ দুই কলেজ সহপাঠীর গল্প। তাদের একজন অনুরাধা নিপাট গৃহবধূ। আর শ্রেয়া একজন যৌনকর্মী। এই যে দুজনের অবস্থানগত পার্থক্য, আদৌ কোনও পার্থক্য আছে কিনা, দুটি বিষয় বা প্রশ্নই উঠে আসে প্রমিতার ছবিকে ঘিরে। স্বল্পদৈর্ঘের এই ছবিতে গৃহবধূ অনুরাধা যেন নিজের সঠিক অবস্থান অনুধাবন করে বন্ধু শ্রেয়ার সঙ্গে কয়েকটি মুহূর্ত কাটাবার মধ্য দিয়ে। শ্রেয়ার পেশা তথাকথিত সামাজিক স্বীকৃত না হলেও, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সে স্বাধীন। নিজের পেশা নিয়ে কোনও হীনমন্যতাও নেই তার। অন্যদিকে অনুরাধা যে সুখের, তৃপ্তির, নিরাপত্তার আশ্রয়ে নিজের যাপনকে দেখতে অভ্যস্ত, তার ফাঁকির দিকটা যেন এক লহমায় তার সামনে চলে আসে শ্রেয়ার উপস্থিতিতে।
এ ছবিতে সংলাপ খুব কম। যদিও, অনেক না বলা কথাই দর্শক শুনতে পাবেন, দুই বন্ধুর সংক্ষিপ্ত কথোপকথনে। শ্রেয়ার মুখোমুখি হওয়ার পর অনুরাধা কী আত্মপরিচয় খুঁজতে শুরু করবে ? তার ভঙ্গুর তাসের ঘরের বাইরে উন্মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়াবে কী সে ? এই প্রশ্নগুলি দর্শককেও আলোড়িত করে। প্রমিতা নিজেই লিখেছেন এর গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ। আজকাল কনটেন্ট নিয়ে খুব কথা বলি আমরা। প্রমিতার ছবির কনটেন্ট তাঁর স্বতন্ত্র ভাবনা, সেই ভাবনার জীবনমুখী প্রকাশে সমৃদ্ধ। ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে এটা নিঃসন্দেহে তাঁর বাড়তি শক্তি ও ক্ষমতার উৎস হয়েছে, যা আমরা ‘পরিচয়’ হয়ে ‘প্রবাহ’-এ দেখতে পাই।
প্রযোজনা স্মাইলিং আর্থ ফিল্মস। প্রমিতার ছবির বিষয়ভাবনা ও বিষয়কে পর্দায় নিয়ে আসতে পারার দৃঢ় প্রত্যয় দেখেই সম্ভবত সুদীপ্তা চক্রবর্তী ও কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তারকা অভিনেত্রীরা প্রমিতার ছবিতে কাজ করতে আগ্রহী হন। এক্ষেত্রে তাঁরা যে ভুল সিদ্ধান্ত নেননি, সেটা প্রথম ছবিতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন এই প্রতিভাময়ী তরুণী। পাশাপাশি সুদীপ্তা-কনীনিকা ছাড়া জীবন্ত হয়ে উঠতে পারতো না শ্রেয়া ও অনুরাধা। সংযত ও সংবেদনশীল অভিনয়ে বরাবরের মতোই হৃদয়স্পর্শী ওঁরা। ছবির সিনেমাটোগ্রাফি রক্তিম মন্ডল। মিউজিক জোয়েল মুখার্জি। সাউন্ড অমিত কুমার দত্ত। কালারিস্ট মানস ভট্টাচার্য। খুব শিগগিরই ডিজিটাল মুক্তি ঘটবে এ ছবির।
‘পরিচয়’ ইতিমধ্যেই মনোনীত হয়েছে মিয়ামি ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, বার্লিন ফ্লাশ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, টরেন্টো ইন্টারন্যাশনাল উইমেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ইতালির গোল্ডেন শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, নিউ ইয়র্ক ফ্লাশ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ইস্তাম্বুল ফিল্ম এওয়ার্ডস, নিউ ইন্ডি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অফ লন্ডন, সুইডেন ফিল্ম এওয়ার্ডস (ফাইনালিস্ট), পুনে শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, চতুর্থ সাউথ এশিয়ান শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (কলকাতা), গোয়া শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, লস এঞ্জেলেস সিনে ফেস্ট, ইন্টারন্যাশনাল গোল্ডেন মিরর ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও ডাবলিন ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। পুরস্কৃত হয়েছে প্যারিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (অনারেবল মেনশন এওয়ার্ড), ম্যাড্রাস ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (বেস্ট উইমেন ডিরেক্টর), ইস্তাম্বুল ফিল্ম এওয়ার্ডস (বেস্ট ন্যারেটিভ শর্ট ফিল্ম), ইন্টারন্যাশনাল গোল্ডেন মিরর ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (বেস্ট ডিরেক্টর, বেস্ট একট্রেস)।
‘প্রবাহ’-এ আমরা দেখবো ৭৫ বছর বয়েসী মৃন্ময়ীকে (মাধবী)। পটভূমি অতিমারী পরবর্তী একটা সময়। মৃন্ময়ী তাঁর স্বামী ও ছেলেকে হারিয়েছেন–অতিমারীর শিকার তারা। শুধু ছেলে বা স্বামী নয়, মৃন্ময়ী হারিয়েছেন আরও আপনজন, আশপাশের মানুষকে। চোখের সামনে বারবার মৃত্যুকে দেখেছেন। আজ মৃন্ময়ী একেবারে একা। তবে, এতকিছুর পরও হতাশায় ভেঙে পড়েননি মৃন্ময়ী। নতুনভাবে জীবন শুরু করতে চান তিনি। জীবনদর্শন বদলে গেছে তাঁর। অতিমারী মৃন্ময়ীকে শিখিয়েছে জীবনের নতুন সংজ্ঞা। সামনে এগিয়ে যাবেন তিনি এবার, ধীরে কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে। জীবনের যাবতীয় হারানো মাধুর্য ফিরে পেতে কোন পথে হাঁটবেন মৃন্ময়ী এবার ? সেই পথে আমাদেরও নিয়ে যাবেন প্রমিতা। মৃন্ময়ী আমাদের শেখাবেন, নিজেকে ভালোবাসাটাও কত জরুরি ?
আগেই বলেছি এ ছবির কাহিনিও প্রমিতার নিজেরই লেখক। পাশাপাশি চিত্রনাট্য-সংলাপও প্রমিতা নিজেই লিখেছেন। প্রযোজনা স্মাইলিং আর্থ ফিল্মস। সিনেমাটোগ্রাফি সুপ্রতিম ভোল। সাউন্ড অদীপ সিং মঙ্কি ও অনিন্দিত রায়। কালারিস্ট সৌমিত্র সরকার। ‘পরিচয়’ ও ‘প্রবাহ’, দুটি ছবিতেই সম্পাদনার কাজটি করেছেন শঙ্খ। স্বল্পদৈর্ঘের এই ছবিতে মাধবী তাঁর অভিনয়ের যাবতীয় ব্যঞ্জনা সহ প্রতিভাত হবেন, একথা সকলেরই জানা। সেই ‘প্রবাহ’-এ ভেসে যেতে প্রস্তুত দর্শকও। শুটিং ও পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শেষ। এবার বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎসবে পাঠানো হবে এই ছবি। সেই পর্ব শেষ হলে ডিজিটাল মুক্তির পরিকল্পনা আছে বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করা প্রসঙ্গে প্রমিতা জানিয়েছেন,”এই অভিজ্ঞতা আমার সারা জীবনের মূল্যবান সম্পদ। প্রথম যখন মাধবীদিকে কাজের কথা ফোনে বলি, উনি আমাকে জানান, গত দু’বছর উনি কোনও কাজ করেননি কোভিডের জন্য। আমার স্ক্রিপ্ট শুনে যদি ওঁর ভালো লাগে, তবেই কাজ করবেন।” সেই অনুসারেই এক সন্ধ্যায় মাধবী মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে যান প্রমিতা। স্ক্রিপ্ট শোনেন মাধবী। আর একবার শুনেই কাজ করতে রাজি হয়ে যান। “এটা আমার কাছে অনেক বড়ো পাওয়া। তারপর একাধিক দিন ওঁর বাড়িতে যাই। ফোনে কথা হয় ছবি নিয়ে। উনি এতো বড়ো মাপের অভিনেত্রী। অথচ, কাজের সময় কখনও বুঝতেই দেননি, আমি একজন নতুন পরিচালক”–আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে জানান প্রমিতা। প্রমিতার কথায়, “কাজের বাইরেও অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে ওঁর সঙ্গে ওঁর বাড়িতে। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের মতো বিখ্যাত চিত্রপরিচালকদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি মাধবীদির মুখে। খুব কম সময়ের মধ্যেই আমি ওঁর স্নেহের অধিকার পেয়েছি। এটা বিরাট প্রাপ্তি আমার কাছে।” তাঁর এই প্রাপ্তির সূত্রেই বলি, প্রমিতা যে চরিত্রে ভেবেছেন মাধবী মুখোপাধ্যায়কে, সেটা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। মৃন্ময়ী একেবারে রক্তমাংসের এক নারী, যাঁর দুঃখ-যন্ত্রণা আমাদের চেনা। যেটা এ ছবির বৈশিষ্ট্য, সমস্ত যন্ত্রণার প্রহর পার হয়ে মৃন্ময়ীর উত্তরণ। এখানে প্রমিতার কলম ও ক্যামেরা কীভাবে অভিব্যক্ত হয়, সেটা দেখার অপেক্ষায় আমরা সকলেই।