Monday, February 3, 2025
বিনোদন প্লাস স্পেশাললাইম-Light

মেগা দেবতার উপাচার জানেন যিনি

লিখেছেন মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা মেগা সিরিয়াল নিয়ে সোশাল মিডিয়ার আলোচনা কিংবা নিজেদের বসার ঘরের আড্ডা থেকে একটা প্রশ্ন বেশ স্পষ্ট। যতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে সিরিয়াল বানানো হচ্ছে, সিরিয়ালের এপিসোডগুলো ততটা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে কি? গল্পটা স্বাভাবিক গতিতে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে অস্বাভাবিক মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে, তার খবর নির্মাতারা রাখছেন তো? শিল্পীদের তারিখ কবে মিলছে, সেই অনুসারে গল্পের সুতো টানা আর ছাড়ার রীতিটা বেশ পুরনো। কিন্তু একটা সময় এই রীতি মেনেও মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য একটা কাহিনি দাঁড় করিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে রবি ওঝা প্রোডাকশনসের পুরনো বেশ কয়েকটি মেগা ধারাবাহিক দেখলে, সে কথা স্পষ্ট হবেই। বাঙালি আজও স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ে রবি ওঝার ‘এক আকাশের নিচে’ প্রসঙ্গে।

তাহলে এই যে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব, এর প্রধান কারণ কী ? সপ্তাহের সাতদিন একটানা মেগা ধারাবাহিক চালানোর হ্যাপা আসলে গল্পের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে দেয় না। স্টুডিওপাড়ার এই সার সত্যটা আপনাকে কেউ মুখ ফুটে বলবে না। তবে ওই যে, ঠারেঠোরে কত লোকই তো কত কথা বুঝিয়ে যায়। একটা কাহিনি রোজ দেখাতে গেলে তাতে কত আর গল্পের মোচড় দেওয়া সম্ভব! তার ওপর আরও বড় সমস্যা, ঠিকমতো কনটেন্ট বা গল্প তৈরির মতো দক্ষ কলম নেই। আর দক্ষ কলম যাঁদের আছে, তাঁদের অনেকেই নিজের সৃষ্টির দশা দেখে ‘শোকে পাথর’।

Images 2 1 1 1
মেগা দেবতার উপাচার জানেন যিনি 15

প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে প্রয়াত, প্রখ্যাত সাহিত্যিক দুলেন্দ্র ভৌমিকের কথা। পরিচিত একজনের সঙ্গে একবার দেখা করতে গেছি তাঁর বাড়িতে। বসার ঘর ভর্তি বই আর পুরস্কার। সুন্দর করে সাজানো সব। ঘুরে ঘুরে বইগুলো দেখছি। অবাক কাণ্ড হল, সেই বইয়ের আলমারিতে কিছুতেই তাঁর অন্যতম সেরা বইটা খুঁজে পাচ্ছি না। সেরা বলার কারণ, সে সময় সেই বইটা নিয়ে বাংলা ছোটপর্দায় সাড়াজাগানো মেগা ধারাবাহিকটি রমরমিয়ে চলছে ! জননী–বাংলা মেগার আলোচনায় আজও ফিরে ফিরে আসে যে নাম।

শেষে দুলেন্দ্র ভৌমিককে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম—আপনার ‘জননী’ বইটার কোনও কপি নেই এখানে ?

এক মুহূর্ত থেমে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর শুধোলেন—বইটা পড়েছ?

—না। সিরিয়ালটা দেখেছি কয়েকটা পর্ব। ওটা তো একেবারে মেগা হিট !

দুলেন্দ্রবাবু এবার নিয়ে গেলেন পাশের ঘরে। সেখানে একটা আলমারিতে রয়েছে ‘জননী’, পাতলা একটা বই!

অবাক হয়ে দেখছি। আমার মনের ভাবটা বোধহয় আঁচ করতে পারলেন তিনি। বললেন—ওইজন্যেই রাখি না। এত পাতলা একটা বইয়ের গপ্পো (পড়ুন গল্পের গরু) একেবারে গাছে তুলে দিয়ে বছরখানেক ধরে চালাচ্ছে। নিজে দেখতেও লজ্জা পাই। ওটা যে আমার লেখা, লোককে সেটা বলতেও লজ্জা করে। কত বছর আগের এই ঘটনা। দুলেন্দ্র ভৌমিকের কথাগুলো যেন এখনও বড় সত্যি। একটু ভুল হলো। বোধহয় এখনই বেশি সত্যি !

একটা গল্পকে যতটা নিংড়ে নেওয়া যায়, তার শেষবিন্দু রসটার পরও টিআরপি-র তাগিদে আরও বেশি রসের যোগান দিয়ে যেতে হচ্ছে নির্মাতাদের। দাবি চ্যানেলের। আবার টিআরপি-র ইঁদুর দৌড়ে টিকে থাকার যুদ্ধে সেই রসে বাস্তবতার ‘ব’ অবধি না থাকলেও চলে। যে উপাদানগুলো সান্ধ্য বিনোদনে এমনিতেই উঁচু সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের কাউকে না কাউকে কখনও না কখনও ডাল ঘোঁটার মতো একটু ঘুঁটে দিতে পারলেই হল। যেমন, বিয়ে, কোঁদল, ষড়যন্ত্র, পরকীয়া এবং সীমাহীন ভাবাবেগ ! বাংলার ক্ষেত্রে এই ধারাগুলোর জনপ্রিয়তা প্রমাণিত ইতিমধ্যেই। ফলে সিরিয়ালের টিআরপি পড়লেই তাকে টেনে তুলতে বিয়ে দেখাতেই হবে। আর বিয়েটাও মোটামুটি সাতদিনের মেগা ইভেন্টে পরিণত করতে হবে। সেই ইভেন্টের পর্বগুলি অর্থাৎ সঙ্গীত, মেহেন্দি ইত্যাদি এখন বাংলা মেগার হাত ধরে বাঙালি বিয়েবাড়ির নয়া সংযোজনে পরিণত। অতএব গল্পটা এসে দাঁড়াল ইভেন্ট অরগাইজেশনে। ইভেন্টটাকে চালু রাখতে যেখানে যেখানে দরকার, একটু গল্পের সুতো ঢোকালেই হল। গল্পও ঠিক নয়, কনটেন্ট। কারণ ওই যে, গল্প লিখিয়ের অভাব।

অথচ, সাহানা দত্তের মতো জনপ্রিয় গল্প-চিত্রনাট্য লিখিয়ে কিন্তু এই সাতদিনের দীর্ঘ মেগা স্লটেই একসময় ‘ভুতু’, ‘গোয়েন্দা গিন্নি’-র মতো একটু ভিন্নধারার গল্প এনে ছোটপর্দা জমিয়ে দিয়েছিলেন। তবে সে সময়টা অবধি এক্সপেরিমেন্টগুলোকে স্বাধীনতা দেওয়া হতো। চ্যানেলের চাপে তাদের নাভিশ্বাস ওঠেনি। কেন জানেন? সাধারণ ঘর গৃহস্থালি তখনও অবধি সিরিয়ালের নেশাটা বুঝত। টিআরপির খেলাটা তাদের জানার বাইরে ছিল। নেশাটা যে মুহূর্তে বিপণনে বদলে দেওয়া হলো, মান পড়ে গেল গল্পের। এখনকার সন্ধেগুলো তিনভাগের একভাগ বিয়ে, দু ভাগের একভাগ ঠাকুরঘর, চারভাগের আড়াই ভাগ নেপথ্যের হিন্দি গান আর নাচ—এমন রেসিপিতে ভাগ করা। এখন দর্শক আর সিরিয়াল দেখেন না। টিআরপি দেখেন।

আর এই প্রেক্ষিতেই উঠে আসে সেই অপ্রতিরোধ্য নামটি। চ্যানেলের চাপ বা দর্শকের ভাবনার দিশাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে কতটা ভারসাম্য রক্ষা করা যায়, সেই উল্লেখে ইদানীং যে নামটা জ্বলজ্বল করছে, তাঁর কথা। পাঠক ঠিকই ধরেছেন। এই প্রতিবেদন লিখতে লিখতে লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাই ভাবছিলাম। মেগার টিআরপি তত্ত্বে তাঁর বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। লীনার মতে, প্রথম পনেরোয় আসা মানেই সেই মেগার একেবারে এক নম্বরে পৌঁছনোর মতো দম থাকে। অন্তত নিজের তৈরি করা মেগা ধারাবাহিকের সাফল্যের ব্যাপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসী লীনা। টিআরপি তালিকাটা যে প্রথম দশের হয়, তা নয়। তবে প্রথম দশেরটা প্রকাশ পায়। কিন্তু অবাক কাণ্ড হচ্ছে, বাংলা ধারাবাহিকের তালিকায় প্রথম পাঁচে পৌঁছে যাওয়ার পরও যেখানে প্রোডাকশন হাউজের বুক ঢিপঢিপ বাড়তেই থাকে, সেখানে লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের এমন একটা ‘কুল’ মন্তব্য যেন রাতে সূর্য ওঠার মতো।

আসল কথাটা অন্যত্র। লীনার সৃষ্টি, তাঁর আত্মবিশ্বাস, তাঁর প্রথম পনেরোয় থাকা মেগার এক নম্বরে নিয়ে আসার ক্ষমতা, সবটাই একান্তভাবে এই ক্ষমতাশালী কলমচির ম্যাজিক। এক তো তাঁর সহজাত লেখন ক্ষমতা। একটা লম্বা সময় সংবাদপত্রে নানা বিষয়ে লিখে নিজেকে ক্ষুরধার করে তুলেছেন তিনি। একালের বাঙালি দর্শক কী চায় বা কী খায়, সেটা লীনার নখদর্পণে। নিন্দুকেরা যতই বলুক, বাংলা মেগা থেকে বাঙালি সংস্কৃতির বিতাড়ন ঘটিয়েছেন তিনি, আমি বলবো লীনা তাঁর কাজটা জানেন। সাফল্যই যে কালে শেষ কথা, তখন বাকি সব তফাতে তো যাবেই। আমরা লীনার সৃষ্টি গ্রহণ করেছি। তাই তিনি সফল ! তাই টিআরপি নিয়ে চিন্তিত হন না তিনি। চাইলেই কলমের আঁচড়ে পরিস্থিতি বদলে পড়তি টিআরপিকে তুলে আনতে পারেন তিনি। আপাতত, তাই তাঁরই শাসন, তাঁরই ফর্মুলায় চলছেন বাংলা মেগা দুনিয়া। মেগা দেবতা তাঁর অঞ্জলিতেই তুষ্ট।

ছবি প্রাপ্তি : গুগল