Monday, February 3, 2025
ওয়েব-Wave

সন্তানহারা বাবা-মায়ের বিচারের দাবিতে ২৫ বছরের লড়াই

হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। এই সপ্তাহে নেটফ্লিক্স -এর ‘ট্রায়াল বাই ফায়ার’ নিয়ে লিখেছেন মৃণালিনী ঠাকুর

মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৯৭ এর ১৩ জুন। দিল্লির অভিজাত এলাকায় অবস্থিত উপহার সিনেমাহলে আগুন লেগে আহত হন অগণিত মানুষ। মারা গিয়েছিলেন ৫৯ জন। কর্তৃপক্ষের অবহেলাতেই ঘটে এই অগ্নি সংযোগ ও সেই হেতু মৃত্যুর ঘটনা। অভিযোগ, আগুন নেভানোর যথাযথ ব্যবস্থা ছিল না হলটিতে। ছিল না আগুনে আটকে পড়া মানুষদের বাইরে যাওয়ার উপযুক্ত পথ। অসহায় মানুষের আর্ত চিৎকারে ভরে উঠেছিল আকাশ বাতাস। ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নীলম ও শেখর কৃষ্ণমূর্তি হারিয়েছিলেন তাঁদের দুই সন্তান উন্নতি আর উজ্জ্বলকে। শোকার্ত বাবা-মা শুধু অপরিসীম দুঃখ, যন্ত্রণা নিয়ে কালক্ষেপ করেননি। তাঁরা এই অন্যায়ের বিচারের দাবিতে সরব হলেন। লড়াইয়ে নামলেন তাঁরা। তৈরি হলো এসোসিয়েশন অফ দ্য ভিকটিমস অফ দ্য উপহার ট্রাজেডি।

সন্তানের অকালমৃত্যুর বিচারের প্রত্যাশায় নীলম ও শেখর কৃষ্ণমূর্তির সেই ২৫ বছরের লড়াইয়ের কাহিনিই হলো ‘ট্রায়াল বাই ফায়ার’। যাবতীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, আজও তাঁদের লড়াই চলছে। যে পরিস্থিতি, যে মানুষ, যে ত্রুটিযুক্ত ব্যবস্থা, যে অবহেলা ও অযত্ন কেড়ে নিল এতগুলি প্রাণ–তাকে সমাজের সামনে উন্মুক্ত করার ব্রত নিয়েই কৃষ্ণমূর্তিরা লিখলেন এই বই। সেই বই তথা সেই সত্য ঘটনা অবলম্বনেই ‘ট্রায়াল বাই ফায়ার’ ওয়েব সিরিজ এখন নেটফ্লিক্স-এর পর্দায়, স্ট্রিমিং শুরু হয়েছে গত জানুয়ারিতে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ‘ট্রায়াল বাই ফায়ার’ এই মুহূর্তে ভারত, পাকিস্থান ও বাংলাদেশের সেরা দশ ওয়েব সিরিজের মধ্যে অবস্থান করছে।

Images 2 22
সন্তানহারা বাবা-মায়ের বিচারের দাবিতে ২৫ বছরের লড়াই 5

প্রসঙ্গত, ‘ট্রায়াল বাই ফায়ার’-এর হিন্দি সংস্করণের নাম ‘অগ্নিপরীক্ষা’। নামকরণেই উপলব্ধ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে এই দম্পতির অদম্য সাহস, সীমাহীন জেদ ও হার স্বীকার না করার মানসিকতার ছবি। ৭ পর্বের এই ওয়েব সিরিজের পর্বে পর্বে এই অবস্থার জ্বলন্ত ছবি প্রাঞ্জল হয়ে উঠেছে। এদেশের প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থার নগ্ন ছবিটি স্পষ্ট এখানে। ঘটনা ঘটার বেশ কিছুদিন পর্যন্ত পুলিশ এফআইআর নিতে অস্বীকৃত হয়। এর কারণটি খুব পরিষ্কার, দুই হল-মালিক সুশীল ও গোপাল অনসল–বলা হয়, এরা প্রায় অর্ধেক দিল্লির মালিক। অর্থাৎ এতটাই ক্ষমতাসম্পন্ন এরা ! এমনকী ল-ফার্মগুলিও এই কেস নেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যায়। সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ ও বিচারের আশা দরজায় দরজায় ধাক্কা খেয়ে মরে। এইসবই উঠে এসেছে ‘ট্রায়াল বাই ফায়ার’-এর পর্বে পর্বে।

Images 2 21
সন্তানহারা বাবা-মায়ের বিচারের দাবিতে ২৫ বছরের লড়াই 6

এই সিরিজে উঠে এসেছে সেইসব সাধারণ মানুষের সাহস, একাগ্র লড়াই ও ধৈর্য্যের কথা–যা তাঁদের অসাধারণ করে তোলে সমাজের বাকি মানুষদের কাছে। ‘ট্রায়াল বাই ফায়ার’ তাই নিছক এক ফিকশন নয়। এখানে কিছু মানুষের যন্ত্রনাময় কাহিনি উঠে আসে তথ্যচিত্রের নিষ্ঠা ও গভীরতায়। যে দেশে খুব সহজেই এমন গুরুতর জাতীয়স্তরের গণ-দুর্ঘটনার কথা মিডিয়াও পাশ কাটিয়ে চলে যায়, সেখানে কৃষ্ণমূর্তিদের এই লড়াই এককথায় দারুণভাবে কুর্নিশযোগ্য। প্রশাসন, আইনব্যবস্থা, রাজনৈতিক দল, হল-মালিক অর্থাৎ সেই কোটিপতি বিল্ডার গোষ্ঠী–প্রত্যেকেই নিজেদের অমানবিক মুখগুলি দেখাতে দেরি করে না এখানেও। সেই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়েই এই দম্পতি বুঝে নেয়, সন্তান তাঁরা হারিয়েছেন, লড়াই তাঁদেরই করতে হবে, সেটা আমৃত্যু হলেও।

সিরিজে কৃষ্ণমূর্তি দম্পতির চরিত্র নিখুঁত করে তোলেন অভয় দেওল ও রাজশ্রী দেশপান্ডে। অত্যন্ত সংবেদনশীল অভিনয়ে প্রতি পর্বে দর্শক হৃদয়ের সূক্ষ তন্ত্রিগুলি ছুঁয়ে যান অভয় ও রাজশ্রী। তেমনই এর দৃশ্য পরিকল্পনা। ছোট ছোট বেদনার্ত ও আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি হয়, যা একেবারেই উচ্চকিত নয়। বরং অনেক বেশি নীরব ও গভীর। সবকিছুর পরও কিন্তু হতাশা নয়, প্রবল ইতিবাচক এবং প্রেরণার বার্তা নিয়েই শেষ হয় এই সিরিজ। শোয়ের নির্মাতা প্রশান্ত নায়ার। তাঁর সঙ্গে আছেন কেভিন লুপার্চিও। পরিচালনার ক্ষেত্রে নায়ারের সঙ্গী হয়েছেন রণদীপ ঝা ও অবনী দেশপান্ডে। দুটি অভিনয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আছেন অনুপম খের ও রত্না পাঠক শা। আছেন আশিস বিদ্যার্থী, রাজেশ টাইলাং প্রমুখ। দ্য স্টোরি ইঙ্ক এবং এন্ডেমল শাইন ইন্ডিয়া যৌথভাবে এই সিরিজ প্রযোজনা করেছে।

Trial By Fire 1
সন্তানহারা বাবা-মায়ের বিচারের দাবিতে ২৫ বছরের লড়াই 7

ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক স্তরে বিপুলভাবে জনপ্রিয় এই সিরিজ। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহে এই সিরিজ দেখার পর কৃষ্ণমূর্তি দম্পতির প্রতিক্রিয়া। নায়ার জানিয়েছেন, ওঁদের এই শো দেখানো ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ। প্রথমে ওঁরা এটা দেখতে পারছিলেন না। পর্দায় হলেও তাঁদের পক্ষে মর্মান্তিক হচ্ছিল এই দর্শন। প্রতি পনের মিনিট অন্তর ওঁরা অফ করে দিচ্ছিলেন শো। কিন্তু এই দম্পতির মানসিক শক্তি সত্যিই অতুলনীয়। পরে ওঁরা শো দেখেন এবং ওঁদের দেখাটা আমাদের সবার জন্য এক বিরাট প্রাপ্তি হয় নিঃসন্দেহে। নেটফ্লিক্স-এর ভিপি কনটেন্ট মনিকা শেরগিল যথার্থই বলেছেন, প্রশান্ত নায়ারের অসাধারণ ফিল্ম মেকিং স্টাইল ছাড়া এমন একটি বিষয় পর্দায় আনা সম্ভব ছিল না। তাঁর সৎ ও অনুপ্রেরণাদায়ক প্রচেষ্টা এই সিরিজের প্রতি পর্বে মেলে। মনিকা এছাড়াও প্রশংসা করেছেন সিরিজের অভিনয় অংশের। সত্যিই তাই। অভয় ও রাজশ্রীর অভিনয় ছাড়া ‘ট্রায়াল বাই ফায়ার’-এর অন্তরকথা বাঙ্ময় হয়ে উঠতে পারত না।