Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

সব দরজা, দরজা নয়

আমাদের পরিক্রমা চলছে ইতিহাস প্রসিদ্ধ মুর্শিদাবাদকে কেন্দ্র করে।গত পর্বে ছিল মুর্শিদাবাদের খোশবাগ।আজ আরও কয়েকটি দ্রষ্টব্য স্থান।

খোশবাগে আমি প্রথমে গিয়েছিলাম এক রোদ ঝলমলে দিনে। খুব ভালো করে সবটা ঘুরে দেখি। একজন দক্ষ গাইডও পাই। প্রসঙ্গত, যে প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি এখন ভারতীয় নৃতত্ব বিভাগের অধীনে, তার সর্বত্র রয়েছেন ওদের নিযুক্ত গাইড। এই ছেলেটি খুব সুন্দর গল্প বলার ভঙ্গিতে সিরাজের কবর, লুৎফার ঘর ইত্যাদি দেখিয়েছিলেন আজও মনে আছে। তাঁর কথা শুনতে শুনতেই মনে হয়েছিল বর্ষায় একবার আসতে হবে খোশবাগে। বড় বেদনাদায়ক এখানকার ইতিহাস। তাকে অনুভব করতেই এক শ্রাবণে আবার হাজির হই সেখানে। সত্যিই সে এক মরমি অবলোকন।

খোশবাগের পর গেলাম হাজারদুয়ারী। সর্বত্রই ক্যামেরা নিয়ে যাবার অনুমতি আছে, দুটি জায়গা ছাড়া–হাজারদুয়ারী ও জগৎ শেঠের বাড়ি। হাজারদুয়ারীর মূল অংশে পৌঁছনোর আগে অনেকটা ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। এই সিঁড়ির ওপর থেকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে গাইড দেখালেন, ওই ওখানে ছিলো হিরাঝিল। ভাগীরথী শুনে যেন মুচকি হেসে বললো, সব যাবে কালের অতলে, আমি বয়ে যাবো চিরন্তন। নদীপথেই তখন যাতায়াত। ফলে, ভাগীরথীর তীরবর্তী অঞ্চলেই প্রাসাদ, বাগিচা ইত্যাদি গড়ে উঠতো সেকালে।

Images 3

হাজারদুয়ারীর প্রবেশদ্বারে নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি সঙ্গত কারণেই। দুর্মূল্য বস্তু অরক্ষিত থাকলেই আমাদের হাত নিশপিশ করে। হাজারদুয়ারী ব্যতিক্রম নয়। এখানকার বহু মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন একটা সময় চুরি গেছে। পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় সরকারের নৃতত্ব বিভাগ এই সৌধের দায়িত্ব নেওয়ার পর অবস্থা বদলেছে। হাজারদুয়ারীর রক্ষণাবেক্ষণ এখন যথাযথ। প্রশ্ন হলো, হাজারটি দরজা কী সত্যি রয়েছে এই প্রাসাদে ? ঘুরে দেখার সময় এই প্রশ্নের জবাবে গাইড হেসে যা জানান, তা এইরকম। এই দরজাগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি দরজা চোখের ভ্রম তৈরি করে। দেওয়ালের গায়ে এমন ভাবে ডিজাইন করা, মনে হবে দরজা, আসলে দেওয়ালেরই অংশ। এই স্থাপত্য কৌশল শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিতেই, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কত যুগ আগে তৈরি এই সৌধের স্থাপত্যকলায় এই আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত কৌশল প্রয়োগ–বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়।

আদতে, এটি নবাবী আমলের একটি দুর্গপ্রাসাদ। পরিচিত নিজামত কিলা ক্যাম্পাস বলে। নবাব নাজিম হুমায়ুন জাহের আমলে এটি তৈরি হয়। ডিজাইনার ছিলেন বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারস-এর ডানকান ম্যাকলিওড। হাজারদুয়ারী দেখার জন্য কমপক্ষে একটা পুরো দিন দরকার। এই সংগ্রহশালা শুধু মুর্শিদাবাদ বা বাংলা নয়, সমগ্র ভারতের এক বর্ণময় ইতিহাসের সাক্ষী। নবাবী আমলের ব্যবহার্য অজস্র মূল্যবান সামগ্রী সংরক্ষিত এখানে। বিস্মিত ও মুগ্ধ করে এর স্থাপত্য। বিভিন্ন তলায় সুরম্য প্রকোষ্ঠে মনোরমভাবে রক্ষিত সামগ্রীগুলি দেখা ও ইতিহাসকে জানা মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা বলতে পারি। হাজারদুয়ারীর পাশেই ইমামবাড়া। ঈদ উৎসবে এই ঐতিহাসিক মসজিদের দরজা খুলে দেওয়া হয় নামাজ পড়ার জন্য। এছাড়া অবশ্য এর ভিতরে প্রবেশের সুযোগ নেই। সাদা ধবধবে রঙের দামি পাথরে তৈরি এই সৌধ বাইরে থেকে দেখতেও অবশ্য বেশ ভালো লাগে।

সিরাজের সঙ্গে ব্রিটিশদের গন্ডগোল, ঘসেটি ও মীরজাফরের ষড়যন্ত্র–এইসবের মাঝে যে মানুষটি নিজের গুরুত্ব বাড়িয়ে নিলেন বাংলার (তখন বাংলা-বিহার-ওড়িশা একত্রে) রাজনৈতিক ও আর্থ সামাজিক মানচিত্রে, তিনি জগৎ শেঠ। তাঁর বাড়িটিও এখন এক সংগ্রহশালা। জগৎ শেঠের প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্রিটিশ আমলেও বহাল ছিলো। একটা গুরুত্বপূর্ণ অবলোকন, সংগ্রহশালায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই যেটা মাথায় এলো, নবাবী শান সৌকর্যের সঙ্গে শেঠ পরিবারের রুচির তফাৎ। অর্থানুকুল্য এখানেও যথেষ্ট। কিন্তু, শিল্প ও সৌন্দর্যবোধ তো শুধু টাকায় হয় না।

এখানে দেখা তিনটি জিনিষ বিশেষ ভাবে মনে আছে। একটি মসলিন শাড়ি, যা কিনা এত পাতলা যে একটি দেশলাই বাক্সে ভরে ফেলা যায়। একটি খাবারের প্লেট, দেখতে অতি সাধারণ, যদিও বিশেষত্ব মারাত্মক। খাবারে বিষ মেশানো হয়েছে কিনা, সেটা এই প্লেটে রাখলেই ধরা পড়ে যাবে, বদলে যাবে খাবারের রং। যুগটা তখন সর্বার্থেই যে ষড়যন্ত্রকারীদের দখলে, বুঝতে অসুবিধা হয়না। এরই সঙ্গে কুর্নিশ জানাতে হয় সেই নাম না জানা রসায়নবিদকে, যিনি এর স্রষ্টা। তৃতীয়টি একটি সুড়ঙ্গ পথ, যা স্থলপথ হয়ে, তারপর ভাগীরথীর মাধ্যমে চলে গেছে কাঠগোলাপ বাগ পর্যন্ত।

বিশাল এলাকা জুড়ে কাঠগোলাপ ফুলের বাগ অর্থাৎ বাগান। রায় বাহাদুর লক্ষীপত সিং দুগার এর নির্মাতা, যিনি ছিলেন একজন ধনী অভিজাত জমিদার। মুর্শিদাবাদের আর্থিক ক্ষেত্রে ইনিও এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। অবকাশে, উদযাপনে ওঁরা সপরিবারে বা সপরিষাদ আসতেন এই বাগানে। বাগানের উঁচু কারুকার্যখচিত  গেট থেকে সোজা রাস্তা চলে গেছে বাগানের মাঝ বরাবর। ভিতরে খুব সুন্দর একটি মন্দিরও আছে। সালঙ্কারা দেবীমূর্তির গঠন ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বস্তু মনে করিয়ে দেয় সেকালের ধনসম্পদের প্রাচুর্য্যকথা। তারপরের ইতিহাস অবশ্য লুঠের। মুর্শিদাবাদ থেকে বহুল পরিমান সম্পদ লুঠ করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সম্পদ এখন নির্লজ্জের মতো লন্ডনের মিউজিয়াম আলো করছে।

(বাকি অংশ পরের সপ্তাহে)

★★ যখনই বেড়াতে যাবেন (নিয়মিত বিভাগ)

🌈 প্যাকিং ফান্ডা

🔺কি কি নিয়ে যাবেন তার একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলুন চটপট। এটা বেশ কয়েকদিন আগেই করুন। এতে জরুরি ও প্রয়োজনীয় জিনিস ভুলে যাওয়ার ভয় থাকবে না।

🔺ব্যক্তিগত জরুরি জিনিস, টাকাপয়সা, ট্রেন বা ফ্লাইটের টিকিট, হোটেলের বুকিং স্লিপ ইত্যাদি এমন জায়গায় রাখুন যা হাতের কাছে থাকবে অথচ বিশেষ যত্ন-খেয়ালও রাখা যাবে। ক্যামেরা, ল্যাপটপ ব্যাগের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য।

🔺 ফার্স্ট এড বক্স, সাধারণ জরুরি ওষুধ এবং আপনি নিয়মিত যে ওষুধ খান তা যথাযথ পরিমানে সঙ্গে রাখুন।

🔺 টর্চ-মোম-দেশলাই অবশ্যই রাখতে হবে।

🔺সানগ্লাস, ছাতা ও বর্ষাতি রাখতে পারলে ভালো।

🔺ভাঁজ নয় জামাকাপড় ফোল্ড করে প্যাক করলে কম জায়গায় বেশি পোশাক আঁটবে। আর জামাকাপড়ের ভাঁজও নষ্ট হবে না।

🔺জামাকাপড়-জুতো ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিন কোথায় যাচ্ছেন, সেই অনুসারে। যেমন, পাহাড়-জঙ্গল-সি বিচ যেখানে, সেখানে হিলতোলা  জুতো নয়, স্পোর্টস শু জাতীয় হলে ভালো। আর পোশাকও প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়। প্রসাধনী ও রূপচর্চার উপকরণও যেটা না হলে নয়, ততটুকুই। মনে রাখুন, বোঝা বাড়ালে পথে চলাফেরায় কষ্ট। শীতের জায়গায় যথেষ্ট শীতপোশাক রাখুন সঙ্গে।

 🔺গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলে সঙ্গে রাখুন কিছু শুকনো খাবার, টি ব্যাগ, কফি পাউডার, গরমজল করার ইলেকট্রিক কেটলি, কাগজের কাপ ও প্লেট, টিস্যু পেপার।

🌈 যাওয়ার আগে কি কি করবেন

◾যথাসম্ভব জায়গাটা সম্পর্কে আগাম খোঁজখবর নিয়ে নিন। স্পটে গিয়ে কি কি দেখবেন, কিভাবে সময় কাটাবেন, তার একটা ধারণা থাকলে সুবিধা হবে আপনার। বাজেট করা ও প্যাকিংয়ের ক্ষেত্রেও এটা জরুরি।

◾জেনে নিন, কাছাকাছি এটিএম, প্রয়োজনে ডাক্তারের ব্যবস্থা আছে কিনা। না থাকলে সেই অনুসারে আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

◾চেষ্টা করবেন থাকা-খাওয়া-যাতায়াত-সাইট সিয়িং-শপিং ইত্যাদি খরচাপাতির জন্য একটা নির্দিষ্ট বাজেট করে নেওয়ার।

◾বেড়াতে গিয়ে যাতে অসুস্থ না হয়ে পড়েন, তার জন্য আগে থাকতেই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।

🌈 আগাম বুকিং এবং

এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত দিক। যাঁরা হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়েন, দল বেঁধে বা একা এবং বুকিংয়ের তোয়াক্কা করেন না, তাঁদের জন্য এই বিভাগ নয়। যাঁরা কিছুটা নির্ঝঞ্ঝাট বেড়ানো পছন্দ করেন, পরিবার পরিজন নিয়ে ভ্রমণ করেন, তাঁরা সচরাচর এডভান্স বুকিং না করে যান না। আমি নিজেও সেভাবেই সারা জীবন ঘুরেছি। এই বুকিংয়ের ক্ষেত্রে অনেকসময়ই এজেন্ট, পাহাড়ের ক্ষেত্রে হোমস্টে মালিক এবং সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে পর্যটকদের নানা বিষয়ে অশান্তির কথা শোনা যায়। এক্ষেত্রে যে সাবধানতা গুলি অবলম্বন করা যেতে পারে—

Img 10 1645154860119

■ এজেন্ট সম্পর্কে ভালো করে আগে খোঁজ নিন

■পাহাড়ের হোমস্টে মালিকরা এমনিতে সৎ। কিন্তু ততটা পেশাদার এখনও নয়। কথাবার্তা, আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও ওদের কিছুটা সমস্যা আছে। ওদের ক্ষেত্রে বার বার জিজ্ঞেস করে, ভাষার কোনও সমস্যা থাকলে, সেটা কাটিয়ে উঠে, নিজের চাহিদা পূরণের ব্যাপারটা আগে থেকে বুঝে নিন।

■ কোনও কারণে বেড়াতে যাওয়া ক্যান্সেল হলে এডভান্স বুকিংয়ের টাকা ফেরত দেওয়া হয় না, এটাই নিয়ম। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আপনার টাকা গচ্ছিত থাকবে ওই এজেন্ট, হোমস্টে মালিকের কাছে এডভান্স হিসেবেই। সেই সময়ের মধ্যে আপনি যেতে পারবেন সেখানে। এই বিষয়টিও বুকিংয়ের সময় পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।

🌈 কি করবেন

◾মানিয়ে চলার চেষ্টা করুন। যেখানে গেছেন, সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে যত বেশি মানিয়ে চলবেন, তত মজা-খুশি-আনন্দ অনন্য প্রাপ্তি হয়ে ধরা দেবে আপনার অভিজ্ঞতায়।

◾যথাসম্ভব পায়ে হেঁটে ঘুরুন। এতে জায়গাটির সত্যিকারের এসেন্সটা পাবেন।

◾জেনে নিন এলাকার মানুষের জীবন, তাদের শিল্প-সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও ইতিহাস।

🌈 কি করবেন না

◾যত্রতত্র প্লাস্টিক, আবর্জনা ইত্যাদি ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না।

◾লক্ষ্য রাখুন আপনার আনন্দ-উল্লাস যেন অপরের বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।