সর্বনাশ ডেকে আনছে রিয়ালিটি শো
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিবস পালন উপলক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে ‘তবু অনন্ত জাগে’-র বিশেষ পর্ব। বিষয় ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত : অনুধাবন ও পরিবেশন’। এই বিষয়ে এই সময়ের প্রখ্যাত শিল্পীদের ভাবনাসমৃদ্ধ প্রতিবেদন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ শ্রাবণী সেন। আলোচনা অজন্তা সিনহা।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তম শিল্পীদের একজন তিনি। পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছেন কন্ঠ ও সঙ্গীত চেতনা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর স্বতন্ত্র প্রতিভা, মেধা এবং বোধ। আর এই সব মিলিয়েই শ্রাবণী সেন একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পী। শ্রাবণীকে ব্যাক্তিগত স্তরে চিনি বহু বছর। ওঁর প্রসঙ্গে সবথেকে জরুরি কথাটা প্রথমেই বলে দেওয়া দরকার। জন্মগতভাবে প্রতিভা ও মধুর কন্ঠের অধিকারী হয়েই নিশ্চিন্তে বসে থাকেননি তিনি। সাঙ্গীতিক দক্ষতার পাশাপশি শুরু থেকেই নিজস্বতা এনেছেন পরিবেশনে। ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত : অনুধাবন ও পরিবেশন’ প্রসঙ্গে যদি বলা যায় শ্রাবণী নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে–অসাধারণ এক বেঞ্চমার্ক প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি–তাহলে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না।
পাঠক মাফ করবেন। একটি ব্যাক্তিগত কথা এ প্রসঙ্গে টেনে না আনলেই নয়। প্রয়াত কিংবদন্তি গীতিকার ও সুরকার অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখি তখন আমি। একদিন একটি প্রেম পর্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখছি। আমার গাওয়া কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না অভিজিৎদার। তারপর হঠাৎই বললেন, শ্রাবণীর থ্রোয়িংটা খেয়াল করেছ কখনও ? কী সুন্দর একটা নিবেদনের ভঙ্গি ! প্রেমের গানে এই ভঙ্গিটা খুব জরুরি। তোমাকে এটা আয়ত্তে আনতে হবে অজন্তা। আমি নিজে বরাবর শ্রাবণীর গানের বিশেষ ভক্ত। কিন্তু এভাবে ওঁর গাইবার বিশেষত্ব কখনও লক্ষ্য করিনি। সত্যি বলতে কী, অভিজিৎদার মতো একজন গুরুর পক্ষেই এমন বিচক্ষণ অবলোকন সম্ভব ! শ্রাবণীর গানে এই যে অভিব্যক্তি আমরা পাই, সেটা আসে যে মনন থেকে, সে তো সেই দীর্ঘ চর্চারই ফসল। এরই পাশাপাশি প্রথাগত শিক্ষার স্তর পার হয়ে গানের আত্মায় প্রবেশের প্রক্রিয়া। গভীর থেকে গভীরতর পথে যাত্রা।
নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা বিষয়ে শ্রাবণীর বক্তব্য প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এই নিরিখেই। ওঁর কথায়, “এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শেখার উৎসাহ খুব বেশি। সমস্যা হলো, শিখতে না শিখতেই টিভিতে, মঞ্চে গাইবার জন্য ছটফটানি। ওদের যত আগ্রহ সেখানেই। এদিকে আবার আজকাল টাকা নিয়ে গান গাইবার সুযোগ করে দিচ্ছে কিছু উদ্যোক্তা ! কী যে মুশকিলের কারণ হচ্ছে এটা ! এভাবে সুযোগ পাচ্ছে বলেই ওদের ভালো করে গান শেখার মানসিকতাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।” এই সঠিক পদ্ধতিতে না শেখা এবং পরিবেশনের যোগ্যতা অর্জন না করেই নিজেকে মেলে ধরার প্রচেষ্টা আজ মহামারীর আকার ধারণ করেছে। ইদানিং ফেসবুক, ইউটিউব সঙ্গীতচর্চা ঘিরে এ ছবি প্রতি মুহূর্তে দেখি আমরা সকলেই।
মনে পড়ছে কলকাতার নেহরু চিলড্রেনস মিউজিয়ামে আয়োজিত এক রবীন্দ্রসঙ্গীত কর্মশালার কথা। সেখানে কয়েকজন অতিথি প্রশিক্ষকের অন্যতম ছিলেন শ্রাবণী। সেই আসরেও পেয়েছিলাম তাঁর অনন্য কয়েকটি গুণাবলির পরিচয়। কীভাবে মাইক্রোফোন ব্যবহার করতে হবে, কোন গানে কোন যন্ত্র বাজবে আর সেই যন্ত্রায়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কী পদ্ধতিতে গাইতে হবে সেই গান–পুরো বিষয়টাই নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন সেদিন শ্রাবণী। আমার আজও মনে আছে, কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা তো বটেই, আমরা বড়রাও মুগ্ধ হয়ে সেই মুহূর্তটি আত্মস্থ করেছিলাম। আরও একবার অনুভব করেছিলাম, কেন শ্রাবণী লক্ষ শ্রোতার হৃদয়ে অধিষ্ঠান করেন। একজন শ্রাবণী সেন হয়ে ওঠা রাতারাতি ঘটে না। এখানে শর্টকাটে যারা বাজি মারতে যায়, তাদের শিল্পী জীবনের আয়ুষ্কালও ওই শর্টকাটেই শেষ হয়।
এত প্রতিকূল একটা আবহের মধ্যেও কিন্তু আশাবাদী শ্রাবণী। নতুনদের প্রতিভা নিয়ে উচ্ছ্বসিত তিনি। বললেন, “গান শেখাতে গিয়ে বা অন্য নানাভাবে প্রচুর ট্যালেন্ট আছে, এমন ছেলেমেয়ের দেখা পাই। খুব তাড়াতাড়ি গান তোলে ওরা। কিন্তু, ওই যে, ধৈর্য নেই। প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে সময় লাগে। সেই সময়টা ওরা দেবে না। আমি জোর গলায় বলতে চাই, টিভি রিয়ালিটি শো এর একটা বড় কারণ। রবীন্দ্রসঙ্গীতও অন্তর্ভুক্ত সেখানে আজ। প্রতিযোগীরা গাইছে। কিন্তু যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে কী ? বিচারকরা সবাইকে একবাক্যে ভালো বলে দিচ্ছেন। এতে যেটা হচ্ছে, আমরা যখন ওদের সঠিকভাবে ভালোমন্দটা বলছি, প্রশিক্ষণে জোর দিচ্ছি, সেটা আর ওদের ভালো লাগছে না। এই রিয়ালিটি শো-টা সবার আগে বন্ধ হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেটা হবে না।”
শ্রাবণীর আশঙ্কা সত্যি মেনেই বলা যায়, রিয়ালিটি শো বন্ধ হবে না। খেলাটা লাখ লাখ টাকার। চ্যানেল থেকে স্পন্সর সকলেরই ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িয়ে এর সঙ্গে। অভিভাবকরা বিভ্রান্ত। তাঁরা ছেলেমেয়েদের তারকা বানাতে ব্যস্ত। গান নয়, এইসব শো এখন টিআরপির চক্করে সস্তা নাটকের চিত্রনাট্য নির্মাণে অধিক উৎসাহী। সাজপোশাকের কথা ছেড়েই দিলাম। কোন গানে কেমন কস্টিউম বা এক্সেসরিজ প্রযোজ্য, তাই নিয়ে কোনও নান্দনিক চেতনা নেই। শ্রাবণী বরাবর সুরুচিসম্পন্ন পোশাকে গান গেয়ে আসর মাত করেছেন দেশবিদেশের মঞ্চে। টিভির অনুষ্ঠান হোক বা নিজের ইউটিউব চ্যানেল, শুরু থেকেই মা সুমিত্রা সেন, দিদি ইন্দ্রাণী সেনের মতো চিরন্তন বাঙালি রুচির অনুসারী তিনি। তাঁদের কাউকেই তথাকথিত ডিজাইনার আউটফিট পরতে হয়নি। নেচেকুদে গান গাইতে হয়নি। সহজ, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সুন্দর রুচির পোশাক পরে এতগুলি বছর শ্রোতার হৃদয় দখল করে রেখেছেন শ্রাবণী। পরম্পরায় আছেন। স্বতন্ত্র পরিচয়ে আছে। থাকবেনও। সস্তা মেলোড্রামা ও গিমিক আজ আছে, কাল নেই। নতুন প্রজন্মকে এই বিষয়টা বোঝানোর দায়িত্ব আমাদের বড়দের।