Saturday, May 18, 2024
তবু অনন্ত জাগে

আমাদের কিশোর আমাদের কৈশোর

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। পড়ছেন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী কিশোরকুমারকে নিয়ে লেখা ধারাবাহিক রচনা। লিখছেন অজন্তা সিনহা। আজ দ্বিতীয় পর্ব।

কিশোরকুমারের জীবন ও গান কোথায় পেশাদারিত্বের চরম দৃষ্টান্ত আর কোথায় কিশোরসুলভ পাগলামির ফসল, সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটু অন্য কথা–দুই কিশোরভক্তের গল্প। একেবারে ভিন্ন পরিবেশে প্রাপ্ত এই অভিজ্ঞতা একেবারে না ভোলা হয়ে থেকে গেছে মনের মণিকোঠায়। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ী পথে চলেছি। যাচ্ছি পেডং থেকে লাভা। অনাবিল প্রকৃতি। একদিকে পাহাড়, তার শরীর বেয়ে পাইনের সমারোহ। উল্টোদিকে নেমে খাড়াই খাদ। গাড়ি চলেছে আঁকাবাঁকা পথ ধরে। এরই মধ্যে হঠাৎ কিশোরকুমার। ড্রাইভার ছেলেটি মিউজিক সিস্টেম চালিয়েছে। এটা বছর পাঁচ/ছয়েক আগের কথা। অর্থাৎ পঞ্চাশ পার করে ফেলেছি রীতিমতো। তা সত্বেও একেবারে কিশোরীর মতো খুশি হয়ে উঠলাম।

এমনিতেই পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে আমার একটা আলাদা বন্ড আছে। ওদের কাছে গেলেই মনে হয় আত্মীয়ের বাড়ি এসেছি। সেদিন কিশোরকুমার আমাদের মধ্যে সেই বন্ড যেন আর একটু পোক্ত করে তুললো। এখানে গাড়িতে যাতায়াতের পথে গান শুনতে শুনতে পাওয়াটা খুব নতুন কিছু নয়। নেপালিরা এমনিতেই সংগীত-নৃত্যপ্রিয় জাতি। ড্রাইভাররা সকলেই যেতে-আসতে মিউজিক সিস্টেম বা এফএম রেডিও চালান। সেখানে নেপালি বা বলিউডের লেটেস্ট হিট গানই বাজে মূলত। পুরোনো গান হলে, সেটা রিমেক। একেবারে কিশোরকুমার এবং যাকে বলে বাছাই কালেকশন। আজও মনে আছে, আমার অবাক প্রশ্নের জবাবে ছেলেটি জানিয়েছিল, সে কিশোরকুমারের গানই শুধু শোনে। দূর পাহাড়ী গ্রামের পথে প্রায় একটা বেলা ধরে, যাওয়া-আসার পথে কিশোরকুমারের গান শোনা, এ যে একেবারে অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি !

আর একটি ঘটনা। এটা সিকিমের। সেবার ওখরে বলে একটা জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছি। শিলিগুড়ি থেকে জোড়থাং হয়ে ওখরে যেতে হয়। নানা কারণে আমার জোড়থাং পৌঁছতে দেরি। তার ফলে গিয়ে দেখি, ওখরে যাওয়ার শেষ সার্ভিস গাড়িটাও ছেড়ে চলে গেছে। নিরুপায় হয়ে একটি গাড়ি রিজার্ভ করা এবং সব ব্যবস্থার পর যখন বের হলাম, তখন সাতটা বেজে গেছে। পাহাড়ী অঞ্চলের হিসেবে বেশ রাত। গাড়ি লোকালয় ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়েই চড়াইয়ে উঠতে শুরু করে। সামনের সিটে ড্রাইভার, বয়স সবে কৈশোর পেরিয়েছে। সঙ্গী আরও ছোট। পিছনে আমি একা। আকাশে সপ্তমীর চাঁদ। তার সঙ্গে চকমকি জ্বালিয়ে আসর সাজিয়েছে তারাদের দল। জোছনায় মাখামাখি শুক্লপক্ষের আকাশ। নির্জন চরাচরে শব্দ বলতে ড্রাইভার ও তার সঙ্গীর মৃদু বাক্যালাপ, যার আবহে বাজছে কিশোরকুমারের গান। সেই রাতেও জানতে চেয়েছিলাম, শুধু কিশোরকুমার কেন, আর কারও গান তার গাড়িতে নেই ? জবাব স্পষ্ট, “আর কারও গান শুনি না ম্যাডাম!” পাঠককে বলার দরকার পড়ে না, এই জবাবটাই ছিল প্রত্যাশিত। দূর পাহাড়ের সেই কিশোরদ্বয় মুহূর্তে হৃদয়ের আরও গভীরে প্রবেশ করে এভাবেই। থেকে যায় স্মৃতিতে।

এই দুটি অভিনব অভিজ্ঞতার বাইরেও দেখেছি বহু মানুষকে। তাঁরা বিভিন্ন বয়সের। দেশে বা দেশের বাইরে–কিশোরকুমারের গানের নিবিষ্ট ভক্ত। অনেকের কাছেই রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডির সংগ্রহ দেখেছি। পরম যত্নে সেসব সংরক্ষণ করেন তাঁরা। এমনকী তাঁর পরপ্রজন্মের অনেক গায়কও আছেন, যাঁরা কিশোরের গান রিমেক করে নিজেদের কেরিয়ার গড়েছেন। স্টাইলের ক্ষেত্রে কিশোরকে অনুসরণ করে যাঁরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, বলিউডের সেই তিন গায়ক কুমার শানু, অভিজিৎ ও বিনোদ রাঠোর তো প্রকাশ্যেই স্বীকার করেন সেকথা। টিভি রিয়ালিটি শোয়ের নির্বাচিত গানের তালিকায় মুখ্যত থাকে কিশোরের গান। কোভিড পরিস্থিতি শুরু না হওয়া পর্যন্ত শহর বা শহরতলী, শিল্পাঞ্চল থেকে গ্রাম-গঞ্জ, জলসায় নতুন শিল্পীদের আসর মাতাবার প্রধান হাতিয়ার থাকতো লিস্টে কিশোরের হিট গান রাখা।

এই যে একজন মানুষের গান ভাষা-অঞ্চল-সংস্কৃতির সীমানা অতিক্রম করে হৃদয় আলোড়িত করার কাজটি প্রজন্মগতভাবে করে চলেছে, এটাই আমার মতে কিশোরকুমার ম্যাজিকের প্রথম ও শেষ কথা। ছয়ের দশকের শেষ থেকে সাতের দশক পুরোটাই আমি যে ম্যাজিকে বুঁদ হয়ে ছিলাম, একুশ শতকে এই রাজ্যেরই অন্য এক প্রান্তে, প্রতিবেশী এক রাজ্যে ভিন্নভাষী দুটি তরুণের মধ্যে সেই আবেশ, সেই আবেগ খুঁজে পেলাম। জন্মগতভাবে কণ্ঠটি নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। কিন্তু তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকেননি। প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি গানে নিজেকে উজার করে দিয়েছেন। এই দেওয়াটা নিঃসন্দেহে তাঁর সময়ের অগ্রগণ্য শিল্পীরা সকলেই দিয়েছেন। কিন্তু কিশোরকুমারের মতো বিজ্ঞানসম্মতভাবে নয়।

হ্যাঁ। বিজ্ঞানসম্মত কথাটাই বলতে চাই আমি এখানে। অপরিসীম সংগীত প্রতিভার পাশাপাশি তিনি যে প্রবল মেধাবী ও বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বোধ ও মননের ভান্ডার ছিলেন। মানুষের হৃদয়বৃত্তি অনুভব করবার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্জন করেন। রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গিয়ে যতবার স্বরলিপি চর্চা করেছি, আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে, আবেগকে কী ব্যাকরণের বাঁধনে বাঁধা যায় ? মন বলেছে, বাঁধা হয়তো যায় না। কিন্তু গাণিতিক প্রতিচ্ছবি নিশ্চয়ই আঁকা যায়। স্পর্শস্বর ও মীরের মাধ্যমে স্বরের মাঝের শ্রুতিগুলিকে এভাবেই লিপিবদ্ধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিশোরকুমারও তাঁর প্রত্যেকটি গানে, শব্দ ও সুরের সেই আলাপন নিখুঁত গাণিতিক মাত্রায় অভিব্যক্ত করেন। আর তাই সব গানে সমান দরদি, হৃদয়স্পর্শী ও সংবেদনশীল হতে পারেন তিনি। কণ্ঠের আনাগোনার ক্ষেত্রেও সবক’টি সপ্তকে, তীব্র ও কোমলে সমান সাবলীল হয়ে ওঠেন। পাঠক মাফ করবেন, এ নিতান্তই একজন সাধারণ সংগীতপ্রেমীর ভাবনা। কোনও বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ নয়। (চলবে)