সুন্দর গাছের অরণ্যে
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম প্রতি সপ্তাহে। এবারে অপরূপ সুন্দরবন। লিখেছেন শ্যামলী বন্দোপাধ্যায়।
পায়ের তলায় সর্ষে না হোক, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, আমি তাঁদের দলেই পড়ি। দেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের প্রাকৃতিক বৈচিত্র থেকে ঐতিহাসিক সমৃদ্ধি–সবই আমায় টানে দুর্নিবার আকর্ষণে। আর করোনাকে ঘিরে যেটা উপলব্ধি করলাম, সেটা হলো, জীবন অনিশ্চিত। তাই যত দূর সম্ভব চেটেপুটে নাও জীবনের রস। এমনই এক মন নিয়ে দমবন্ধকর লকডাউনের বিধিনিষেধ ওঠার পরেই ২০২১-এ পরপর গেলাম দার্জিলিং ও সিকিম। ফিরেই কর্তামশাইয়ের সঙ্গে আলোচনায় ঠিক হলো, পরবর্তী গন্তব্যস্থল আর পাহাড় নয়। আর এই প্রেক্ষিতেই উঠে এল একেবারে দুয়ারের কাছের সুন্দরবনের নাম।
‘জলে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘ’–দর্শন হোক বা না হোক, প্রকৃতিকে প্রাণখুলে উপভোগ করার জন্য এর চেয়ে ভাল জায়গার কথা আর মনে আসেনি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। জল আর জঙ্গলে ঘেরা অদ্ভুত গা-ছমছমে এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ। প্রসঙ্গত, গত বছর ডিসেম্বর মাসে যখন আমাদের যাওয়ার দিন ধার্য হলো, ঠিক সেই সময়ই আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ছিল, ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদ’। ওদিকে সব টাকাপয়সা দেওয়া হয়ে গেছে ট্যুর অপারেটরকে। ট্যুর ক্যানসেল করলে অতগুলো টাকা জলে চলে যাবে। কাজেই ‘মন চলো সুন্দরবনে’ বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, যাই হোক না কেন প্রোগ্রাম বাতিল করব না।
নির্দিষ্ট দিনে নির্ধারিত সময়ে ট্রাভেল এজেন্সির গাড়ি দরজায় হাজির। মনের সব দুশ্চিন্তা দূরে সরিয়ে রেখে ব্যাগপত্তর নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। মাঝে রাস্তায় এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে চা ও সামান্য কিছু খাবার খেয়ে আবার এগিয়ে চললাম। পাকা রাস্তা ধরে দু পাশের গ্রাম বাংলার অসাধারণ দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। ঘন্টা দুয়েক পর গিয়ে পৌঁছলাম গদখালি নামের ফেরিঘাটে। সেখানেই অপেক্ষা করছিল আমাদের লঞ্চ। লঞ্চের ওপরের দিকে সুন্দর বসার জায়গা। আর নিচে সাজানো গোছানো ঘরের মতো থাকার ব্যবস্থা। করোনার পরে অনেকেই একটু খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির মধ্যে থাকতে চেয়েছিল সে সময়ে। তাই লঞ্চে আমাদের সঙ্গী ছিলেন আরও জনা পনেরো ট্যুরিস্ট।
লঞ্চে বসে মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তোলার সময় মনে পড়ে গেল প্রথমবার সুন্দরবন যাওয়ার কথা। এই প্রেক্ষিতে সেই অভিজ্ঞতাও খানিকটা ভাগ করে নেব পাঠকের সঙ্গে। সেটা ছিল ২০০২ সাল। গিয়েছিলাম ‘বনবিবি উৎসব’ উপলক্ষে। একদম একা। হাতে সেই সময় মোবাইলও আসেনি। কোনও ধারণাই ছিল না সুন্দরবন যাত্রা কতটা কঠিন। শুনেছিলাম, শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে ক্যানিং স্টেশনে নেমে ওখান থেকে ফেরিঘাটে গিয়ে লঞ্চে করে গোসাবা পৌছতে হবে। সেখান থেকে যেতে হবে রাঙ্গাবেলিয়া, সেখানেই অনুষ্ঠান। সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে বারাসাত স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে শিয়ালদহ, সেখান থেকে দক্ষিণ শাখার ট্রেন ধরে ক্যানিং। এরপর ফেরিঘাটে গিয়ে ১২টা নাগাদ লঞ্চে বসলাম। ভেবেছিলাম, ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাব। কোনও ধারণাই ছিল না রাস্তা সম্পর্কে। তাই লঞ্চ ছাড়ার পরে দেখছি, সে চলছে তো চলছেই। চারদিকে শুধু জল, আর পাড়ে জঙ্গল। একটা জায়গায় জলের স্ফীতি দেখে ভয়ই লাগছিল। বিভিন্ন জায়গায় লঞ্চে যাত্রী ওঠানামা করছিল। সে এক অন্যধরনের অভিজ্ঞতা ! ঝুঁকি বেশি। সব মিলিয়ে স্মৃতিতে না ভোলা হয়ে রয়েছে।
এবারের যাত্রা অবশ্য তার থেকে অনেকটাই আলাদা। উপভোগ্যতা ভিন্ন মাত্রায়। তার একটা বড় কারণ হয়তো, এবার আর একলা নই। সঙ্গী বেটার হাফ আছেন সঙ্গেই। বেড়ানোর ক্ষেত্রে তিনিও আমারই মতো আগ্রহী ও উৎসাহী। যাওয়ার পথে লঞ্চেই দুপুরের ভুরিভোজ সারা হল। প্রথমে গেলাম সজনেখালি ম্যানগ্রোভ ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার অ্যান্ড টাইগার রিজার্ভ-এ। এখানে ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে সুন্দরবনকে দেখতে অসাধারণ লাগল। যত দূর চোখ যায় সবুজের সমারোহ। আর নানারকম পাখির মিষ্টি আওয়াজ। এখান থেকেই গাইড সঙ্গী হলেন। তিনি সুন্দরভাবে বলে চললেন এই বিশ্বখ্যাত অরণ্য সম্পর্কে।
প্রায় ১০০০০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই সুন্দরবনের পশ্চিমবঙ্গ অধীনস্থ অংশের আয়তন প্রায় ৪২৬০ বর্গ কিলোমিটার। এখানকার বৈচিত্র্যময় গাছেদের মধ্যে প্রধান হল সুন্দরী গাছ। এই গাছের কথা মাথায় রেখেই নামকরণ করা হয়েছে সুন্দরবন। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে স্থান পেয়েছে এই অরণ্য। মনে পড়ে যাচ্ছিল, বনশ্রী সেনগুপ্তের সেই বিখ্যাত গান–‘সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ, সবচেয়ে সেরা সেই যে গাছ’। এছাড়া অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে গেওয়া, গরান, কেওড়া ইত্যাদি। ঘরের চাল ও বেড়া বানানোর জন্য গোলপাতাও পাওয়া যায় এখানেই। সুন্দরবনে আছে প্রায় ৫০ জাতের পতঙ্গ, পশু ও সরীসৃপ। তাদের মধ্যে বিষাক্ত সাপের সংখ্যা যথেষ্ট। কুমির থেকে শুরু করে হরিণ, বানর, শিয়াল, বন মোরগ, বন বিড়াল ও মৌমাছি সহ কতরকম যে প্রাণী আছে তা স্বল্প পরিসরে বলা মুশকিল!
পরবর্তী গন্তব্য ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত হ্যামিলটন সাহেবের বাংলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুনেছিলেন স্কটল্যান্ডের এক সাহেব কৃষি, হস্তশিল্প ও পশুপালনের মধ্য দিয়ে সুন্দরবনের অর্থনীতিতে বড়সড় পরিবর্তন এনেছেন। তাই নিজের চোখে তা দেখার জন্য হ্যামিল্টন সাহেবের আমন্ত্রণে অসুস্থ শরীরেই এখানে এসেছিলেন। উঠেছিলেন কাঠের এই বাংলোয়। যদিও বাংলোর সংস্কারের কাজ চলছিল বলে আমাদের আর ভিতরে যাওয়া হলো না। কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে ফিরে চললাম লঞ্চে। সন্ধের আগেই পৌঁছে গেলাম রিসর্টে। সুন্দর সাজানো গোছানো রিসর্ট। ঢুকতেই ছোট্ট এক মন্দির। নানারকম ফুল গাছ দিয়ে সাজানো। আমাদের ঘরটি ছিল দোতলায়। ফ্রেশ হয়ে আমরা সবাই হাজির অডিটোরিয়ামে। সেখানে চা-পকোড়া সহযোগে উপভোগ করলাম স্থানীয় অধিবাসী মহিলাদের নাচ।
এরপর রিসর্টের ভিতরেই খানিকক্ষণ পায়চারি করা। নদীর ধারেই রিসর্ট হলেও রাতে গেটের বাইরে বের হওয়া বারণ। কারণ, বন্য জন্তু-জানোয়ার কখন কোন দিক থেকে এসে পড়বে, তা আগে থেকে আন্দাজ করা মুশকিল। রাতে ডিনার সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। ট্যুর ম্যানেজার রাতেই জানিয়ে দিলেন পরদিন আটটায় ফের বেরনো। আর তার মধ্যেই সবাইকে ব্রেকফাস্ট সেরে রেডি হয়ে নিতে হবে। আমরাও সেভাবে তৈরি হয়ে নিলাম। ওদিকে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাব সেদিন একটু একটু করে পড়তে শুরু করে দিয়েছে। আকাশে ভারী না হলেও অল্পস্বল্প মেঘ দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিও পড়ছে মাঝে মাঝে। মাতলা নদী পেরিয়ে বিদ্যাধরী হয়ে দোবাঁকি খালের কাছেই আছে দোবাঁকি ক্যাম্প। সুন্দরবনের সঙ্গে অন্য জঙ্গলের ফারাক হলো, অন্যান্য জঙ্গলে পায়ে হেঁটে কিংবা হাতি অথবা গাড়িতে চড়ে ঘোরা যায়। কিন্তু সুন্দরবনে জলেই ঘোরাঘুরি। তবে, এই জায়গাটা কিছুটা আলাদা। এখানে পায়ে হাঁটা যায়।
এই ক্যাম্পের দু দিকে মাটি থেকে অনেকটা উঁচু পর্যন্ত তারের জাল দিয়ে ঘেরা ঝুলন্ত সেতু। তার ভিতর দিয়ে হেঁটে কিছুটা এগিয়ে আছে ওয়াচটাওয়ার। তার আগে পড়ে বনবিবির মন্দির। আছে একটা মিষ্টি জলের পুকুর, যেখানে দেখা মিলল বক ও মাছরাঙার। ব্যাঘ্র মহাশয়ের দর্শন অবশ্য মেলেনি। যদিও একটা প্রচলিত কথা আছে, সুন্দরবনে আপনি বাঘের দেখা পান বা না-ই পান, বাঘ কিন্তু আপনার ওপরে নজর রাখে। সেটা মনে করেই খানিকটা সান্ত্বনা পেলাম। সেখান থেকে লঞ্চে ফেরার পরেই দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হল। জমিয়ে খাওয়াদাওয়ার পর আবার যাত্রা। এবার লঞ্চ এগিয়ে চললো জঙ্গলের কোর এরিয়ার দিকে। দেখলাম, জঙ্গলের বাইরের দিকে নাইলনের জাল দিয়ে ঘেরা, যাতে বাঘ আসতে না পারে। কারণ, নদীর উল্টো পাড়েই গ্রাম।
মোহনার কাছাকাছি চারদিকের বিস্তৃত জলরাশি দেখে মনের কোণে একটু হলেও ভয় বাসা বেঁধেছিল। এর মধ্যে বেশ জোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। লঞ্চের ওপরে থাকা একরকম অসম্ভব হয়ে উঠল। আমরা নিচের দিকে থাকার জায়গায় আশ্রয় নিলাম। সেখান থেকে যদিও খুব ভাল করে জঙ্গল দেখা যাচ্ছিল না। ওদিকে প্রশাসন সতর্কতার জন্য সব লঞ্চকে ঘাটে ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমাদেরও ফিরে আসতে হলো। সন্ধ্যায় বাউল গানের আসর বসল। ফিশ ফ্রাই আর কফি সহযোগে জমে গেল আসর। রাতে খেয়েদেয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন আরও কিছু জায়গায় যাওয়ার ছিল। কিন্তু জাওয়াদের জন্য তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হল কলকাতার দিকে। সুন্দরবনের অনেক কিছুই অদেখা থেকে গেলেও যা দেখেছি, তার রেশই যে বহুদিন থেকে যাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এবার বলি, সুন্দরবন কীভাবে যাবেন ! শিয়ালদা থেকে ট্রেনে ক্যানিং স্টেশনে। সেখান থেকেই ট্যুর অপারেটররা অটো করে সোনাখালি নিয়ে যান। এরপর ভটভটি বা লঞ্চে চেপে সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়া। আবার কলকাতা থেকে বাসে সোনাখালি কিংবা গদখালি গিয়েও সুন্দরবন যাওয়া যায়। ট্যুর অপারেটরদের কেউ কেউ ধর্মতলা অথবা সায়েন্স সিটি থেকে বাসে করে নিয়ে যায়। আবার ট্রিপ শেষে ওখানেই ছাড়ে। নিজেদের গাড়ি নিয়ে গেলে গদখলি বা সোনাখালিতে রেখে যেতে হবে। ট্যুর অপারেটররা কেউ হোটেলে, কেউ আবার লঞ্চে থাকার ব্যবস্থা করেন। যার যেমন পছন্দ, তেমনটা বেছে নিতে পারেন। সরকারি লজে থাকতে হলে, সজনেখালিতে রয়েছে। তাদের কলকাতা অফিসে বুকিং করতে হবে। ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে গেলে বেড়ানোটা ঝঞ্ঝাটবিহীন হয়। তবে, ভালো করে খোঁজ খবর নিয়ে নিন আগেই। মোটামুটি সকলেরই ওয়েবসাইট আছে। সেখানে যোগাযোগ পাবেন। আপনার প্রয়োজন কী কী, সেটা পরিষ্কার কথা বলে নিন আগে থেকেই। খরচ এক এক ট্যুর অপারেটরের ক্ষেত্রে এক এক রকম। মূলত প্যাকেজ সিস্টেম। খরচ প্যাকেজ অনুসারে। তবে, সবটাই মধ্যবিত্তের আয়ত্তের মধ্যেই মেলে।
ছবি : লেখক