Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

আমাদের কিশোর আমাদের কৈশোর

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। পড়ছেন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী কিশোরকুমারকে নিয়ে লেখা ধারাবাহিক রচনা। লিখছেন অজন্তা সিনহা। আজ পঞ্চম পর্ব।

রাজেশ খান্না অভিনীত প্রথম যে ছবিটি দেখা মাত্রই আমি একেবারে তাঁর প্রেমে পড়ে গেলাম, সেই ছবিটির নাম ‘মেরে জীবন সাথী’, নায়িকা ছিলেন তনুজা। সেটা ১৯৭২ সাল। বয়স একটু বেড়েছে তখন। প্রেমের বোধটাও অন্যরকম। রাজেশ খান্নার ক্রেজ তখন তুঙ্গে। শুধু আমি কেন, দক্ষিণ ভারত বাদ দিলে, সারা দেশের কিশোরী ও তরুণীকুল হিন্দি ছবির প্রথম সুপারস্টারের জন্য উন্মাদ। আজ বুঝি, সেদিনের উন্মত্ত অনুরাগের অনেকটা জুড়ে ছিল, তাঁর লিপে কিশোরের গান। রাজেশ অত্যন্ত ক্ষমতাশালী একজন অভিনেতা নিঃসন্দেহে। কিন্তু তাঁর যে রোমান্টিক ইমেজ, যার জোরে তিনি সুপারস্টার, সেটা লিপে কিশোরকুমারের গান ছাড়া গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না।

সত্যি কথা বলতে কি, সে ছিল সবদিক থেকেই এক স্মৃতিভারাতুর সময়। আমাদের প্রজন্ম মানে যাঁদের আজ ছয়ের কোঠায় বয়স, তাঁরা তখন কৈশোর ও তারুণ্যের সন্ধিক্ষণে। মনের ভিতরে উথালপাথাল ঢেউয়ের সময়। রাজেশ খান্না-কিশোরকুমার মিলে সেই ঢেউয়ে যেন প্লাবন এনে দিলেন। এরই সঙ্গে আবার যোগ দিলেন শচীনকর্তার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী রাহুল দেববর্মণ। তামাম ভক্তের কাছে কোথাও তিনি আর ডি, কোথাও পঞ্চম। রাজেশ খান্নার লিপে আমরা শুনলাম ‘কাটি পতঙ্গ’, ‘অমর প্রেম’,’আপ কি কসম’, ‘অগর তুম না হোতে’, ‘কুদরত’, ‘মেহবুবা’, ‘রোটি’, ‘আপনা দেশ’, ‘হাতি মেরে সাথী’, ‘আন্দাজ’, ‘নমক হারাম’, ‘সফর’,’খামোশি, ‘আজনবী’, ‘অনুরোধ’,’সাচ্চা ঝুটা’, ‘দাগ’,’ দো রাস্তে’ ইত্যাদি ছবির গান। এর কিছু আর ডি-র সুর, কিছু অন্যান্যদের।

Images 20
আমাদের কিশোর আমাদের কৈশোর 9

অন্যদিকে পঞ্চম সুরে কিশোর গাইলেন ‘খুশবু’, ‘বুঢ্ঢা মিল গয়া’, ‘গোলমাল’, ‘নামকিন’, ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’, ‘হীরা পান্না’, ‘শৌকিন’, ‘মঞ্জিল’, ‘বড়ে দিলওয়ালে’, ‘রকি’, ‘জওয়ানি দিওয়ানি’,’ দ্য বার্নিং ট্রেন’, ‘শোলে’ ইত্যাদি ছবিতে। দেবানন্দ, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, অমল পালেকর, ধর্মেন্দ্র, রণধীর কাপুর প্রমুখ–ব্যপ্তিটা বুঝুন প্রিয় পাঠক। প্রসঙ্গত, এর পরের প্রজন্মের নায়করাও আছেন। তালিকা দীর্ঘতর হবার ভয়ে আপাতত থামলাম। এখানে একটা কথা বলতেই হবে, ‘কুদরত’-এর ‘হামেঁ তুম সে প্যার’ আর ‘মেহবুবা’ ছবির ‘মেরে নয়না শাওন ভাদোঁ’ গানদুটির প্রথমটি ‘কুদরত’ ছবিতে পারভীন সুলতানা গেয়েছিলেন। ‘মেহবুবা’-য় লতাজি। তবু, শ্রোতারা শুনতে বেশি পছন্দ করেছে কিশোরের গাওয়া গান দুটিকেই। কারণ, স্পষ্ট ! সেই অমোঘ আবেগের ছোঁয়া।

এবার শুধু কয়েকটি গানের নাম, বিভিন্ন সুরকারদের সৃষ্ট–পাঠক খুব সহজেই ভেসে যাবেন স্মৃতি ও আবেগের জোয়ারে। সুরকারদের মধ্যে আছেন লক্ষীকান্ত প্যারেলাল, কল্যানজি আনন্দজি, সলিল চৌধুরী, খৈয়াম, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আর ডি বর্মণ, শ্যামল মিত্র, হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর, রবীন্দ্র জৈন, রাজেশ রোশন, বাপি লাহিড়ী প্রমুখ। না ভোলা সেই গানগুলি হলো–মেরে মেহবুব কেয়ামত হোগি, মেরে নসীব মে এয় দোস্ত, ইয়ে জীবন হ্যায়, মেরে দিল মে আজ কেয়া হ্যায়, কোয়ি হোতা জিস কো আপনা, মুসাফির হুঁ ইয়ারো, ইয়াদোঁ কি বারাত, মেরা জীবন কোরা কাগজ, নেহি ম্যায় নেহি দেখ সকতা, ঘুঙরু কি তরহা, সারা প্যার তুমহারা, হাজার রাহেঁ, গুজর গয়ে দিন দিন, জিন্দেগি আ রহা হুঁ ম্যায়, জিন্দেগি কা সফর, জীবন সে ভরি, তেরে য‍্যায়সা ইয়ার কাহাঁ, পল পল দিল কে পাস, দিল কেয়া করে, কেয়া নজারে কেয়া সিতারে, কিসি শায়ের কি গজল, চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত, ছুঁ কর মেরে মন কো, নীলে নীলে অম্বর এবং আরও অনেক। অনন্ত প্রতিভা, অতুলনীয় সাঙ্গীতিক দক্ষতা এবং সঙ্গীত বিষয়ে তাঁর অপরিসীম আকুলতা কিশোরকে কয়েক প্রজন্মের কাছে পূজনীয় করে তুলেছে। পূজার ফুল ভালোবাসা হয়ে তরঙ্গে তরঙ্গ মিলিয়েছে। এই বিষয়টিকে অভিব্যক্ত করা শব্দের বন্ধনে এক অসম্ভব কাজ ! (চলবে)