Sunday, May 19, 2024
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

কেমন আছো কাশ্মীর?

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম।

নিবিড়, নান্দনিক নিসর্গের কাশ্মীর বরাবর পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রে। ভূস্বর্গ কাশ্মীর নিয়ে আমাদের যত অহংকার, তত যন্ত্রনা। স্বাধীনতার পর কেটে গেল এতগুলি বছর, বদলালো না কাশ্মীরের ভাগ্য। সুন্দর প্রকৃতির মাঝে কেমন আছেন এখানকার মানুষ ? তাঁদের যাপনও কী এমন সুন্দর ? পড়ছেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ের কলমে। ধারাবাহিক রচনার অষ্টম পর্ব আজ।

লিডারের কোল বেয়ে ঝকঝকে পাহাড়ি পথ। পথের দুপাশে দোকানপাট, বাড়িঘর, হোটেল, অফিস, পুলিশ স্টেশন, ব্যাঙ্ক, স্কুল সবকিছু। বারোটা শৈলশিখর দিয়ে ঘেরা পাহাড়ী শহর পহেলগাঁও-এর অপরূপ সৌন্দর্যের প্রাণ সঞ্জীবনী দুরন্ত লিডার। লাঞ্চের পরে আমরা বেশ খানিকটা চড়াই ভেঙে পৌঁছে গেলাম জে কে টুরিজিমের কটেজে। সবুজ লন, ছোটো ছোটো ফুলের বাগান, তার মাঝে মাঝে একজোড়া করে সবুজ কটেজ ধাপে ধাপে ছবির মত সাজানো। সামনে ছোট্ট ব্যালকনি, পেছনে ডাইনিং-হল লাগোয়া কিচেন। প্রতি একজোড়া কিচেনের জন্য একজন করে কেয়ার-টেকার। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সবকিছু দেখার দায়িত্ব তার।

কটেজে লাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে কেয়ার-টেকারকে রাতের মেনু বলে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সাইট সিইং-এর জন্য। এখন মেহরাজ আমাদের ড্রাইভার নয়, সহযাত্রী। কারণ, লোকাল সাইট সিইং-এর জন্য লোকাল ট্রান্সপোর্ট নিতে হয়। জানা গেল, পহেলগাওঁ-এর আশেপাশের সাইট সিইং-এর ভরসা ঘোড়া বা ট্রেকিং। কিছু কিছু জায়গা জোঙা জিপ গাড়িতে ঘোরা যায়। অমরনাথের তীর্থযাত্রা শুরু হয় পহেলগাঁও থেকে ১৬ কিমি দূরে চন্দনবাড়ি থেকে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম জিপগাড়িতে যতটুকু ঘোরাঘুরি করা যাবে, ততদূর পর্যন্ত যাব।

প্রথমে যাওয়া হলো পাঁচ কিমি দূরের বেতাব ভ্যালিতে। ভয়ঙ্কর রাস্তা, প্রচন্ড খাড়াই। শুনলাম বেতাব সিনেমার শুটিং হয়েছিল এখানে। তারপর থেকেই পাহাড়-নদী-লেক দিয়ে সাজানো এই ভ্যালির নামকরণ হয়েছে, বেতাব ভ্যালি। জিপ থেকে নামতেই ঘিরে ধরল একদল ছেলে–বয়স ১৩/১৪ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। তারা গাইড। ওদের সিরিয়াল নম্বর আছে। রেটও ফিক্সড। আমাদের ভাগে যে গাইড পড়লো তার নাম মকবুল। বয়স ১৬-১৭। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সে ঘুরিয়ে দেখাল সব। ফেরার সময় জিজ্ঞেস করে জানা গেল, মকবুল ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র। স্কুলের পরে এখানে কাজ করে। ঘরে অসুস্থ মা, দুটো ছোট ভাই -বোন। সেই একই ছবি। কঠিন দারিদ্র।

কটেজে ফিরতে ফিরতে সাড়ে ছটা। প্রচন্ড ঠান্ডা। ঘরে ঢুকতেই ইমরান ( কেয়ার-টেকার ) বলল, চা দেব? আমরা উৎফুল্ল হয়ে চা আনতে বললাম। ফ্রেশ হয়ে চা খেতে খেতে বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম। ধীরপায়ে সন্ধে নামছে। এরই মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি শুরু হলো। আর মিনিট দশেকের মধ্যেই ঝপ করে লোডশেডিং। জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে হাজির হলো ইমরান। শুনলাম প্রতিদিনই সন্ধেবেলায় বৃষ্টি আর লোডশেডিং হয় এখানে। আবার দশটা নাগাদ এসে যায় কারেন্ট। আমাদের কথামতো সাড়ে নটায় ডিনার দিয়ে দিল ইমরান। আলুভাজা আর চিকেন কারি দিয়ে ধূমায়িত গরম ভাত। ঠিক তখনি আলোও জ্বলে উঠল। ইমরান ছেলেমানুষের মাত একমুখ হেসে বলল, আজ জলদি আ গয়া।

রুম হিটারের ব্যবস্থা না থাকায় বেশিক্ষণ আড্ডা জমলো না। সারাদিনের ক্লান্তিও ছিল। বিছানায় মনে হলো জল ঢেলে কেউ ভিজিয়ে রেখেছে। কিন্তু বিছানা গরম করার ইলেকট্রিক মেশিন চালু করতেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। পরদিন আমাদের প্রোগ্রাম –সকালের দিকে আরু ভ্যালি ঘুরে এসে হেঁটে পহেলগাঁও শহরটা ঘুরে দেখব। সকালে পাখিদের কিচিরমিচিরে ঘুম ভেঙে গেল। মেহরাজকে আগেই বলে রেখেছিলাম। সে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাতে ছিল। সাড়ে আটটা নাগাদ ইমরান রুটি সবজি আর ডিমসেদ্ধ দিয়ে গেল। ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি হয়ে বেরিয়ে দেখি, মেহরাজ এসে গেছে।

আবার জোঙ্গা গাড়িতে চেপে ওপরে ওঠা, বাঁ দিকে লিডার। পহেলগাঁও থেকে আরু ভ্যালির দূরত্ব ১১কিমি। আমরা উঠছি লিডারের আপ-স্ট্রিম-এর দিকে। ৩৬ কিমি ওপরে কোলাহাই হিমবাহ থেকে উৎপত্তি লিডারের। মাউন্ট কোলাহাই পিক কাশ্মীর উপত্যকায় হিমালয়ের সর্বোচ্চ পিক, উচ্চতা ১৭৭০০ ফুট। ওপর থেকে সশব্দে দুরন্ত বেগে নেমে আসছে লিডার। আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম আরু ভ্যালি। ছোট্ট জনপদ। জিপ রেখে হাঁটা শুরু করলাম আমরা। জনপদ ছাড়াতেই চোখে পড়লো পাহাড় আর সবুজ পাইন-এ ঘেরা সবুজ ঘাসের কার্পেট বিছানো অবারিত মাঠ। মাঝে মাঝে সাদা বরফের আলপনা।

এখানেও বহু বিখ্যাত ছবির শুটিং হয়েছে। ‘বজরঙ্গী ভাইজান’ ফিল্মের শেষদৃশ্যে লিডার নদীর দুপারে যে জনসমাবেশ দেখানো হয়েছিল, মেহরাজ বলল, সেই জনতার ভিড়ে সেও উপস্থিত ছিল। প্রত্যেককে একহাজার করে টাকা দেওয়া হয়। কাশ্মীরের দূর দূর প্রান্ত থেকে লোক জোগাড় করা হয়েছিল। লিডারের শাখানদী আরু বয়ে যাচ্ছে ভ্যালির ডান দিকে। লিডার আর আরুর সৃষ্টি এই সুদৃশ্য উপত্যকা। সেইজন্য আরু ভ্যালি লিডার ভ্যালি নামেও পরিচিত। আরু ভ্যালির বিশেষ গুরুত্ব ট্রেকিং বেসক্যাম্প-এর জন্য। এখান থেকেই কোলাহাই হিমবাহ, টারসার লেক, মাশার লেক ইত্যাদি দুর্গম জায়গায় যাবার জন্য ট্রেকিং শুরু হয়।

আমরা মুগ্ধ হয়ে ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে ফিরে এলাম পহেলগাঁও শহরে। একটা ধাবায় লাঞ্চ সেরে নিয়ে পায়ে হেঁটে শহর ঘোরা শুরু করলাম। মেহরাজ গাড়ি আনতে চলে গেল। অনবদ্য প্রকৃতির কোলে সাজানো ছবির মতো পহেলগাঁও শহরের দোকানগুলোও সাজানো খেলাঘরের মত। কাশ্মীরের সবরকম পণ্য এখানে পাওয়া যায়। তবে বেশি দামী জিনিস না কেনাই ভালো। কারণ কোয়ালিটি বোঝা কঠিন। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চমৎকার আবহাওয়ায় দোকানে দোকানে সাজিয়ে রাখা রঙবেরঙের পোশাক-আশাক ইত্যাদি দেখতে দেখতে ঘুরে বেড়ানো বেশ উপভোগ্য। লিডারের কাছে  কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে কটেজে ফিরে এলাম আমরা ।

ইমরান যেন আমাদের ফেরার অপেক্ষাতেই বসেছিল। হাসিমুখে আপ্যায়ন করে চা আনতে চলে গেল। মেহরাজও বিদায় নিল। পরদিন সকালে পহেলগাঁও ছেড়ে জম্মুর উদ্দেশে রওনা দেব। পহেলগাঁও থেকে জম্মুর দূরত্ব ২৫৩ কিমি। গাড়িতে সময় লাগে প্রায় ছ’ঘন্টা। লম্বা জার্নি। সুউচ্চ পাহাড়ি পথে প্রচুর চড়াই-উৎরাই। ফ্রেশ হয়ে চা-টা খেয়ে আমরা ব্যালকনিতে বসলাম আড্ডা দিতে। এ সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। সামনে অস্তগামী সূর্যের আলোয় পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় বিচিত্র রঙের খেলা চলছে। ঠান্ডাও বাড়ছে। অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ ঝোড়ো হওয়ার সঙ্গে বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেল গতকালের মতো। আমরা ঘরে এসে মোমবাতি দেশলাই রেডি করে রাখলাম। ইমরানের কথা অনুযায়ী এরপরেই লোডশেডিং হয়ে যাবে। ঠিক তাই হলো। আমরা মোমবাড়ি ধরানোর আগেই ইমরান জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে হাজির হলো। (চলবে)

ছবি : লেখক