Monday, February 3, 2025
সম্পাদকীয়

একটা বিতর্ক তুলে দিলেই হলো

এই ট্রেন্ড নতুন কিছু নয়। বিখ্যাত ও কিংবদন্তি মানুষকে আক্রমণ, কটূক্তি, সমালোচনা করে তাকে বিতর্কে পরিণত করা এবং এই বিতর্কের সূত্র ধরেই নিজে লাইমলাইটে আসা অতীতেও ঘটেছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এর শিকার হয়েছেন। ইতিহাসে সজনীকান্ত দাসের নাম রবীন্দ্র-নিন্দুক রূপেই থেকে গেছে। রবীন্দ্রনাথ কালকে উত্তীর্ণ করে এমন এক স্তরে, যেখান থেকে কোনও বিতর্কই তাঁকে আসনচ্যূত করতে পারবে না। যতদিন মানবসভ্যতা, ততদিন মানুষের চেতনা ও মননে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ। সাম্প্রতিককালে একটি বিখ্যাত বাংলাগানকে কেন্দ্র করে একজন নবীন চিত্র পরিচালকের মন্তব্যে তুমুল ঝড় উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায়। সেটা দেখেই মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথ-সজনীকান্ত বৃত্তান্ত।

সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এখন যে যা খুশি লিখতে বা বলতে সক্ষম। সোহিনীও একটি গান নিয়ে ওই ‘যা-খুশি’ ধরণের একটা কিছু বলেছেন নিজের ফেসবুক ওয়ালে। সারেগামা থেকে ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত এই গানের সঙ্গে ভারতের একজন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী, একজন অসম্ভব প্রতিভাবান কবি ও গীতিকার এবং এক অসাধারণ সুরকার জড়িত–যথাক্রমে মান্না দে, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও সুপর্ণকান্তি ঘোষ। পরিচালক সোহিনী দাশগুপ্ত বলেছেন, কালজয়ী, নস্টালজিক ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই…’ গানটি নাকি ‘সাতটা ন্যাকার ঘ্যানঘ্যান’ শোনায় তাঁর কানে।

এতটাই ঘ্যানঘ্যানে লেগেছে তাঁর গানটা যে, সকালে রেডিওতে শোনা মাত্র তিনি বিষোদ্গার করেছেন ফেসবুকে। ইতিমধ্যেই সোহিনীর সম্পর্কে উল্টে লোকজন যা যা বলা যায়, রুচিশীল ও রুচি বিহর্গীত, বলছেন তাঁরাও। এখন কিছুদিন এই নিয়ে চলবে, সেটাও জানা। কথা হলো, কে এই সোহিনী দাশগুপ্ত ? তাঁর পরিচয় যতটুকু জানা যাচ্ছে, তিনি প্রখ্যাত পরিচালক প্রয়াত বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সহকারী ও স্ত্রী। কয়েকটি তথ্যচিত্র বানিয়েছেন। সোহিনী পরিচালিত একমাত্র ফিচার ছবিটি মুক্তির অপেক্ষায় । এর বাইরে ছাপ রাখার মতো বা খুব আলোড়ন সৃষ্টিকারী কিছু তিনি এখনও করে ফেলেছেন বলে কোথাও খুঁজে পেলাম না।

এবার প্রশ্ন তিনি কেন এই বিতর্ক তৈরি করলেন ? কয়েকটি হেরে যাওয়া মানুষকে নিয়ে লেখা ঘ্যানঘ্যানে গানটি কী তিনি সেদিনই প্রথম শুনলেন ? এ গান একটা লম্বা সময় ধরে বাঙালির হৃদয় অধিকার করে রেখেছে। কফি হাউসকে ঘিরে গৌরীপ্রসন্ন যে অপরূপ কাব্যকথার জাল বোনেন এই গানে, তা বাঙালির কয়েক প্রজন্মের যাপনের অংশীদার। সুপর্ণকান্তির সুর একেবারে নিপুণ সৃজনে সেই কথার মায়াময় নস্টালজিকে অনুসরণ করে। সবশেষে মান্না দে’র গায়ন–কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয় যেখানে।

আটের দশকে গানটি তৈরির পর থেকে মান্নাবাবু যতদিন পারফর্ম করেছেন, এমন কোনও জলসা ছিল না, যেখানে এই গানটির অনুরোধ আসেনি তাঁর কাছে। মান্নাবাবু নিজেও বড় ভালোবাসতেন গানটা। পছন্দ করতেন গাইতে। এমনকী তাঁর গান পরপ্রজন্মের যে সব শিল্পী মঞ্চে গেয়ে থাকেন, তাঁরাও শ্রোতাদের অনুরোধে গানটা গাইবার তালিকায় রাখেন। এঁরা সকলে বা এই গানের ভক্ত অগণিত শ্রোতা–সবাই কী ওই সোহিনীর ভাষায় ঘ্যানঘ্যানের দলে ?

কফি হাউসের সেই আড্ডাটা…বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, তার একান্তের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে। সোহিনী হঠাৎ সেই জায়গাটায় আঘাত করে কী প্রমান করতে চাইলেন ? তিনি ব্যতিক্রমী ? যে দু-চারজন সোহিনীর এই বক্তব্যের সমর্থনে মন্তব্য করেছেন, তাঁরাই বা কী ভেবে কী করছেন ? মান্না দে, গৌরিপ্রসন্ন চলে গেছেন। সুপর্ণকান্তি অত্যন্ত ভদ্র একজন মানুষ। তিনি প্রতিবাদ করলেও, শালীনতার মাত্রা ছাড়াবেন না। বাকি রইলো এই গানের ভক্তরা। তাঁরা অবশ্য ছাড়ছেন না, ছাড়বেন না সোহিনীকে। এভাবেই নেতিবাচক প্রচারে লাইমলাইটে আসা ? বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সংস্কৃতি তো এটা নয় ! সোহিনী কী শিখলেন ওঁর কাছে ?!