Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

একাকীত্বের মাঝেই গীতার চিরবিদায়

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। ৯২তম জন্মবার্ষিকীতে বাংলার বিস্মৃতপ্রায় কিংবদন্তি অভিনেত্রী গীতা দে’র প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য। লিখেছেন দেবজিৎ সাহা

তিনি আজ বিস্মৃতপ্রায়। অথচ বাংলা মঞ্চ ও সিনেমার অঙ্গন প্রবলভাবে ঋণী তাঁর অতুলনীয় অবদানে। তাঁকে জনমদুখিনী বললে ভুল হবে না। সারাটা জীবনই কেটেছে অপরিসীম জীবনযুদ্ধে। অত্যন্ত ক্ষমতাশালী অভিনেত্রী গীতা দে’র জন্ম ৫ই আগস্ট, ১৯৩১–মৃত্যু ১৭ই জানুয়ারি, ২০১১। শিশুশিল্পী হিসাবে মাত্র ছ’বছর বয়সে তাঁর অভিনয় জীবন শুরু। সে সময় তাঁরা থাকতেন কলকাতার দর্জিপাড়ায়। 

ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলা সিনেমা ও থিয়েটারে সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করে গেছেন গীতা দে। বাবা অনাদিবন্ধু মিত্র মেয়ের গান ও অভিনয়ে প্রবল ঝোঁক দেখে, তাঁকে প্রতিবেশী গায়িকা রাধারানী দেবীর কাছে তালিম নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তাঁর কাছেই গীতার প্রথম জীবনের নাচ, গান, অভিনয় শিক্ষা। ১৯৩৭ সালে মাত্র ছ’বছর বয়সে তিনি ‘আহুতি’ নামে একটি বাংলা ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পান। ছবিটির পরিচালক ছিলেন শ্রদ্ধেয় ধীরেন গাঙ্গুলি।

Images 163
একাকীত্বের মাঝেই গীতার চিরবিদায় 11

তাঁর পিতা অনাদিবন্ধু মিত্র পেশায় ছিলেন একজন নামকরা বিলেত ফেরত ডাক্তার। মা পরমাসুন্দরী, নাম রেনুবালা দেবী। কিন্তু, মাত্র ৫ বছর বয়সেই বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ গীতার জীবনকে সংগ্রামের দিকে ঠেলে দেয়। সেই সময় আদালতের তরফ থেকে শিশু গীতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সে কার সঙ্গে থাকতে চায় ! গীতা বাবার বদলে মাকেই বেছে নিয়েছিলেন। মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে মা বলেছিলেন–“কি বোকা রে তুই! ডাক্তার বাবার কাছে থাকলে, ধনীর দুলালী হতিস। আমি কিই বা তোকে দিতে পারবো!” ধনীর দুলালী সেদিন মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে বলেছিলেন, “মা আমি তোমার সঙ্গেই থাকবো।” বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ তাঁর পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল। বড় স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি গীতা। বেশিদূর পড়াশোনাও করতে পারেননি।

Images 173
একাকীত্বের মাঝেই গীতার চিরবিদায় 12

গীতার বয়স যখন ১৩-১৪, তখনই আচমকা তাঁর মা মারা যান। পৃথিবীতে সম্পূর্ণ অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন গীতা। ভাইবোনকে নিয়ে মামার বাড়িতে ঠাঁই হয় তাঁর। সেখানে চূড়ান্ত দুর্ব্যবহার ও অনাদর জোটে কপালে। নিজের ও ভাইবোনদের অন্নসংস্থানের জন্য গীতাকে দাসীবৃত্তিও করতে হয় মামার বাড়িতে। সেই চরম দুঃসময়ে গীতার পাশে এসে দাঁড়ালেন নাট্যাভিনেত্রী বন্দনা দেবী। ভাইবোন সমেত গীতা গিয়ে উঠলেন তাঁর বাড়ি। বন্দনা দেবী বুক দিয়ে আগলে রাখলেন গীতা ও তাঁর ভাই-বোনদের। তিনি হয়ে উঠলেন গীতার বন্দনা মা। বন্দনা মায়ের সৌজন্যেই নাট্যকার শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে আলাপ হলো গীতার। সেখানে প্রথম প্রথম বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে হতো তাঁকে। এই নিয়ে গীতার মনে অসন্তোষও ছিল। কিন্তু, শীঘ্রই তিনি বুঝতে পারলেন, এই নাট্যমঞ্চই তাঁর সামনে অভিনয়-স্বর্গের দরজা খুলে দিতে চলেছে।

Images 18
একাকীত্বের মাঝেই গীতার চিরবিদায় 13

তাঁর বয়স যখন ১৫, সে সময়ে কলকাতার তালতলা নিবাসী ব্যবসায়ী অসীমকুমার দে’র সঙ্গে বিয়ে হয় গীতার। ব্যবসায়ী স্বামী, ধনী শ্বশুরবাড়ি, দামী আসবাবপত্রে সুন্দর করে সাজানো সেই বিশাল বাড়ির বউ হলেন গীতা। সে বাড়ি দেখে অনেকেরই তাক লেগে যেত। কিন্তু জনমদুখিনী গীতার সুখ সইলো না স্বামীর ঘরে। না, কোনও দাম্পত্য বিবাদ নয়। তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভরভরন্ত সংসার। কিন্তু, বৌমা নাটকে কাজ করে বলে শাশুরির তাঁকে মোটেই পছন্দ ছিল না। হাওয়াবদলের নাম করে গীতাকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে, ছেলের আবার বিয়ে দিলেন তিনি। ফিরে এসে গীতা সবটা জানতে পারলেন। এরপর শ্বশুরবাড়ির থেকেও আশ্রয়চ্যুত করা হয় গীতাকে। ছোট ছোট ভাইবোন এবং সন্তানদের নিয়ে সেদিন আক্ষরিক অর্থেই তাঁর ঠাঁই হয়েছিল রাস্তায়।

Images 192
একাকীত্বের মাঝেই গীতার চিরবিদায় 14

বিয়ের পাঁচ বছর পর, স্বামী পরিত্যক্তা গীতা ১৯৫১ সালে নতুন করে বাংলা সিনেমায় যোগ দিলেন। সে সময়ে তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি ছিল ‘শিল্পী’। পরে ‘অগ্রদূত’ পরিচালিত ‘লালু ভুলু’। ১৯৫৬ সাল ছিল গীতার কাছে একটি যুগান্তকারী বছর। সেই বছরই কিংবদন্তি পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের স‍‌ঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দেন অভিনেতা কালী ব্যানার্জি। গীতা দে সেই সূত্রে পরপর অভিনয় করেন ঋত্বিক ঘটকের তিনটি ছবিতে–মেঘে ঢাকা তারা (১৯৫৭), কোমল গান্ধার (১৯৫৯) এবং সুবর্ণরেখা (১৯৬০)। সত্যজিৎ রায়ের ‘তিনকন্যা’ এবং দেবকীকুমার বসুর ‘সাগর সঙ্গমে’ ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছেন। ‘তিনকন্যা’ ছবির শেষগল্প ‘সমাপ্তি’-তে তিনি ছিলেন অপর্ণা সেনের মা।

Images 202
একাকীত্বের মাঝেই গীতার চিরবিদায় 15

এছাড়াও তিনি অভিনয় করেছেন তপন সিংহের ‘হাটেবাজারে’, ‘জতুগৃহ’, ‘এখনই’ ছবিতে। গীতা দে’র অভিনয় জীবন ৬০ বছরের, অনেক কথা লিখতে হয়। এই স্বল্প পরিসরে সব ছবির উল্লেখ সম্ভব নয়। তবু, উল্লেখ করতেই হয় তাঁর অভিনীত অজয় করের ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘নৌকাডুবি’, ‘মাল্যদান’, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘নিশিপদ্ম’, ‘দুই ভাই’, ‘বর্ণচোরা’, ‘মৌচাক’ ইত্যাদি ছবির নাম। বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন সাবলীলভাবে। চরিত্রগুলির মধ্যে সহজে ঢুকে যেতে পারতেন বলে দর্শক গীতার অভিনয় দেখে আনন্দ পেতেন। যিনি সৃজনশীল, আনন্দ দেন, তাঁকে মানুষ ভোলেন না।

তথাকথিত ভাবে কোনও দিনই ‘তারকা’ ছিলেন না গীতা। কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী একজন অভিনেত্রী ছিলেন। প্রায় ছয় দশক ধরে সিনেমা এবং রঙ্গমঞ্চে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবন জুড়ে তিনি শিশির ভাদুড়ি, দেবকী বোস, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং তপন সিংহ ছাড়াও বাংলার অন্যান্য প্রখ্যাত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেন।

১৯৫৬ সাল থেকে টানা ১৮ বছর গীতা দে ‘স্টার থিয়েটারে’ অভিনয় করেছেন। তখন সেখানে পরিচালক ছিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। ১৯৭৬ সালে তিনি যোগ দেন কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে। সেখানে ‘অঘটন’ নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন জ্ঞানেশ মুখার্জির পরিচালনায়। পরে অভিনয় করেন সমরেশ বসুর ‘বিবর’ নাটকে, যেখানে পরিচালক ছিলেন রবি ঘোষ। গ্রুপ থিয়েটারে তিনি অভিনয় করেছেন বেশ কিছু বিখ্যাত পরিচালকের সঙ্গে। তাঁরা হলেন, তুলসী লাহিড়ী, শম্ভু মিত্র, তুলসী চক্রবর্তী, জ্ঞানেশ মুখার্জি, কালী সরকার, কানু ব্যানার্জি, দিলীপ রায় প্রমুখ । 

Images 222
একাকীত্বের মাঝেই গীতার চিরবিদায় 16

তিনি দীর্ঘদিন আকাশবাণীর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। প্রসঙ্গত, গীতার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা ও চিত্র পরিচালক লরেন্স অলিভার। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন–“গীতা দে ভীষণ শক্তিশালী অভিনেত্রী। ও ভালো গানও জানে। ওর অভিনয় জীবন শুরু শ্রীরঙ্গমে, খুব ছোটবেলায়। তারপরে শিশির ভাদুড়ির কাছে ওর নাট্যশিক্ষা এবং একই সঙ্গে নাটকে অভিনয়। সিনেমাতেও চরিত্রাভিনেত্রী হিসাবে দুর্দান্ত অভিনয় করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ডাইনি’।”

Images 242
একাকীত্বের মাঝেই গীতার চিরবিদায় 17

যদিও সিনেমা-থিয়েটার দর্শকদের কাছে চিরকাল দজ্জাল, মুখরা, কুচুটে চরিত্র হয়েই থেকে গিয়েছিলেন গীতা। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত সংবেদনশীল, পরোপকারী, স্নেহশীল মানুষ ছিলেন তিনি। এই গুণী ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অভিনেত্রীর শেষ জীবন কেটেছে চরম অভাব, অবজ্ঞা আর একাকীত্বে। কাউকে পাননি পাশে! একাকীত্বের মাঝেই ৭৯ বছর বয়সে এই মহান অভিনেত্রী কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।