কাবুলিওয়ালা আর মিনির সঙ্গে বড়দিন
অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর কেরিয়ারের অন্যতম সেরা অবদান হয়ে থাকবে রহমত Kabuliwala । লিখেছেন অজন্তা সিনহা
মিনি রহমতকে জিগ্যেস করে, “তোমার ঠাকুর আছে? তার নাম কী?”
জবাবে রহমত, “আছে, তার নাম আল্লাহ।”
মিনি বলে, “ও, তোমার ঠাকুরের নাম আল্লাহ। আর আমার ঠাকুরের নাম ‘ঠাকুর’। এই নাও প্রসাদ খাও।”
রহমত খেতে যেতেই মিনি বলে,”আগে নমো করো।”
মিনি যা শেখায়, রহমত সেটাই ধারণ করে শেষ অবধি। শেষে যখন মিনি তাকে চিনতে পারে না, তখন রহমত বলে, “বাবুজি, মেরে মন্দির সে মেরা ভগবান চলা গয়া।”ওপরের এই কথোপকথন, বর্ণনা, সেখান থেকে রহমতের উপলব্ধি–এখানেই যেন ‘কাবুলিওয়ালা‘ ছবির আত্মা লুকিয়ে। এই বিষয়টি অনুভব না করলে, সেই আত্মাকে ছোঁয়া যাবে না।
আফগানিস্তান থেকে জীবিকার তাগিদে কলকাতায় এসেছে রহমত। এখানে এসে মিনির সঙ্গে তার পরিচয়। তারপর কী কী ঘটে, তার বিস্তারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কাহিনি সকলেরই জানা। চিরন্তন কাহিনিকে সময়ের বীক্ষণে দেখার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন পরিচালক সুমন ঘোষ। আর তাঁর চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার যে মিঠুন চক্রবর্তী, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ছবির ট্রেলার দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে, আর কেউ এমনভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃষ্ট ‘কাবুলিওয়ালা‘ হয়ে উঠতে পারতেন না! মিঠুনের অভিনয়ের ব্যাপ্তি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে, এটুকু বলতেই হবে, রহমত তাঁর কেরিয়ারের অন্যতম সেরা অবদান হয়ে থাকবে। আমাদের সবারই স্মৃতিতে তপন সিংহ পরিচালিত ‘কাবুলিওয়ালা‘, যা প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তা সত্ত্বেও বলব, মিঠুন এই ছবিতে স্বমহিমায় উজ্জ্বল! একবারের জন্যও কোনও তুলনা দর্শকের মন বা মননে আসবে না।
সুমনের ‘কাবুলিওয়ালা‘ Kabuliwala সম্পর্কে এরপরই যে কথা বলা অত্যন্ত জরুরি, তা হলো, সময়ের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে রবীন্দ্র-কাহিনির চিত্রনাট্য রচনা! সুমনের সঙ্গে চিত্রনাট্য লেখায় সহযোগী হয়েছেন শ্রীজীব। সংলাপও শ্রীজীবের লেখা। দু’টি অসম বয়সী মানুষ, বিশাল ভৌগলিক দূরত্বের দুটি অঞ্চল এবং একেবারে ভিন্ন সংস্কৃতি ও আর্থসামাজিক স্তরের প্রতিনিধির মধ্যে মানবিক আদানপ্রদান। অনির্বচনীয় এই কাহিনি কলমে এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানেও আমরা দেখি সমাজের স্বার্থান্বেষী চক্র কেমন করে থাবা বসায় এই অপরূপ সম্পর্কের কোমলতায়। আমরা এও দেখি স্বার্থান্বেষীরা কেমন করে খেপিয়ে তোলে সাধারণ ধর্মান্ধ মানুষজনকে। তৎকালীন সেই কাহিনি আজও প্রাসঙ্গিক। বাস্তবসম্মত ভাবে সেই গল্পকে কতটা স্মার্ট ও মননশীল ভাবে পর্দায় হাজির করেছেন সুমন, ট্রেলারে তার অনেকটা আভাস মেলে।
অভিনেতা মিঠুনের কথা শুরুতেই বলেছি। যে মানুষগুলি পর্দায় বাহ্যত মিঠুনকে নিখুঁতভাবে ‘কাবুলিওয়ালা‘ রহমত করে গড়ে তুলেছেন, তাঁদের কথাও একটু বলা প্রয়োজন ! রাজর্ষি মুখার্জির কস্টিউম ডিজাইন ও শেখ মহম্মদ আলতাফ হুসেনের মেকআপ নিঃসন্দেহে আগাগোড়া দর্শকের চোখ টেনে রাখবে। এবার অন্যদের কথা। বাকি মুখ্য চরিত্রের অভিনয়ে আবির চট্টোপাধ্যায় (অরবিন্দ), সোহিনী সরকার (স্নেহলতা) ও অনুমেঘা কাহালি (মিনি)। অনুমেঘা অর্থাৎ আমাদের নতুন যুগের মিনির কথা আলাদা করে পরে বলব। আবির-সোহিনী বাংলা বিনোদনের দুটি নির্ভরযোগ্য নাম–অভিনয় করেছেন মিনির বাবা-মায়ের চরিত্রে। তাঁরা এই ছবির যথার্থ অংশ হয়ে ওঠায় নিজেদের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখবেন, এমনটা নিশ্চিত বলা যায়।
আবির ও সোহিনীর মেকআপের দায়িত্বে আছেন যথাক্রমে অয়ন রায় ও সানু সিংহ রায়। মিঠুন ছাড়া বাকিদের কস্টিউম ডিজাইন করেছেন অভিষেক রায়। কলকাতা ও কারগিলের পটভূমিতে বাঙ্ময় ছবির অন্তরকথা। এর অনেকটা কৃতিত্বই পাবেন সিনেমাটোগ্রাফার শুভঙ্কর ভড়, তাঁর ক্যামেরা কথা বলেছে। এরই সঙ্গে বলতে হবে প্রোডাকশন ডিজাইনার ও আর্ট ডিরেক্টর তন্ময় চক্রবর্তীর কথা। কাহিনির প্রেক্ষিত গড়ে তুলতে কোনও ত্রুটি রাখেননি তিনিও। সম্পাদনা সুজয় দত্ত রায়। কোরিওগ্রাফি আদিল শেখ। ছবির গান লিখেছেন শ্রীজাত বন্দোপাধ্যায় ও অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের সঙ্গীত পরিচালনা ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর প্রতিবারের মতোই দর্শক অভিজ্ঞতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এবার আমাদের মিনির কথা! সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিঠুন অনুমেঘা সম্পর্কে বলেছেন, শি ইজ গোয়িং টু বি আ সুপারস্টার! এমন এফর্টলেস অভিনয়, এইটুকু মেয়ের! বড় বড় সংলাপ এক এক টেকে ‘ওকে‘ করেছে। এই সার্টিফিকেট নিশ্চয়ই অনুমেঘার জন্য যথেষ্ট দামি। তবে, এই ছবিতে মিনি হয়ে ওঠার আগেই টিভি সিরিয়ালের দৌলতে ক্ষুদে তারকা অনুমেঘা। ‘বোধিসত্ত্বর বোধবুদ্ধি‘ ধারাবাহিকে আত্মপ্রকাশ এই প্রতিভাময়ী কন্যার। তারপর ‘মিঠাই‘ এর মিঠি ! জনপ্রিয়তা আর একটু বাড়ল। এবার ‘কাবুলিওয়ালা‘র Kabuliwala মিনি। সহজাত অভিনয় ক্ষমতায় আজকের মিনিকে পর্দায় কোন পর্যায়ে প্রাণময়ী করে তুলেছে সে, তার অনেকটা পরিচয় ট্রেলারেই পাওয়া যায়। জীবন্ত কিংবদন্তি মিঠুন চক্রবর্তী থেকে বাকি সকলের সঙ্গেই সমান স্বচ্ছন্দ অনুমেঘা।
শোনা যায়, এই ছবি করার আগে পরিচালককে মিঠুন বলেছিলেন, ‘কাবুলিওয়ালা’ Kabuliwala করতে গেলে সেরকম প্রোডিউসার চাই, যাঁর ছবি করার প্রতি ভালোবাসা আছে এবং এর কোনও বাজেট থাকবে না। বাজেট বেঁধে ফেললে এই ছবি করা উচিত নয়। তিনি যথার্থই বলেছিলেন। সত্যি বলতে কী, এই মুহূর্তে টলিউডে একমাত্র এসভিএফ-এর মতো প্রযোজকই পারে ‘কাবুলিওয়ালা’ প্রযোজনা করতে। খরচে কোনও কার্পণ্য না করে তাঁরা ১৯৬৫-এর কলকাতাকে রিক্রিয়েট করেছেন। আউটডোর ছিল কারগিল, পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত! বলা বাহুল্য, এমন এক লোকেশনে শুটিং করার জন্য আর্থিক ক্ষমতার পাশাপাশি ভাবনার প্রসারতাও প্রয়োজন। জিও স্টুডিওজ ও এসভিএফ এন্টারটেনমেন্ট-এর নিবেদন এই ছবি প্রযোজনা করেছেন জ্যোতি দেশপান্ডে এবং শ্রীকান্ত মোহতা ও মহেন্দ্র সোনি।
শেষ করব মিঠুনের কথাতেই। একটি প্রথমশ্রেণির দৈনিক সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, এই ছবি তিনি জামালকে ডেডিকেট করেছেন। আফগানিস্তানি পাঠান জামালউদ্দিন খান ছিলেন তাঁর রাঁধুনি–মিঠুনের শুটিং স্পটের একনিষ্ঠ সঙ্গী। তারকা ইমেজ কোনোদিনই মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় বাধা সৃষ্টি করেনি মিঠুনের ক্ষেত্রে। আর এভাবেই জামালউদ্দিন তাঁর পরম বন্ধু হয়ে ওঠেন। মিঠুন জানিয়েছেন জামালকে হৃদয়ে রেখেই নিজের মধ্যে রহমতকে গড়ে তুলেছেন তিনি। রহমতের সংলাপের ক্ষেত্রে যে অ্যাকসেন্ট, সেও জামালের সূত্রেই প্রাপ্ত। বলা ভালো অনুপ্রাণিত। একজন মহৎ অভিনেতা তো এভাবেই তাঁর কাজের রসদ কুড়িয়ে নেন আশপাশের জীবনের কাছ থেকে। এক বাবা ও এক মেয়ের মরমি কাহিনি ‘কাবুলিওয়ালা’ বাঙালির আসন্ন বড়দিন সার্থক করে তুলবে, প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।
প্রসঙ্গত, ছবি মুক্তি পাবে আগামী ২২ শে ডিসেম্বর। তার আগেই অবশ্য ইউটিউব চ্যানেলে এসে গেল ‘খুশির ঈদ’ (Khusi Ki Eid)–এক অপরূপ সুরেলা ও প্রাণছোঁয়া সেলিব্রেশন। জিও স্টুডিওজ ও এসভিএফ এন্টারটেনমেন্ট বড়দিনে Kabuliwala ছবি মুক্তির আগে রিলিজ করল ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের কম্পোজিশন ছবির এই মিউজিক ভিডিও, যা প্রাণ পেয়েছে শিল্পী জাভেদ আলির কণ্ঠে। ভিডিওতে পাওয়া যাবে, ঈদের পটভূমিতে রহমত ও মিনির মধ্যে গড়ে ওঠা হৃদয়ছোঁয়া বন্ডের একটি অতুলনীয় ঝলক ! ঈদ উৎসবের মূল যে কথা–সেই একতার বার্তা, মহা মিলনের ভাবনা–সেই অনন্যতাই প্রতিভাত হয়েছে ভিডিওটিতে। অসাধারণ গানের অনবদ্য ভিসুয়াল–তাতে থাকছেন মিঠুন চক্রবর্তী, অনুমেঘা ও আবির চট্টোপাধ্যায়। সমস্ত প্রথম সারির মিউজিক প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যাবে কাবুলিওয়ালার ‘খুশির ঈদ’!
দেখার জন্য ক্লিক করুন–