ফরেস্টের দিশি রূপ
লাল সিং চাড্ডা আসছে আগস্টেই
লিখেছেন অজন্তা সিনহা
আমির খান মানেই চমক। কেরিয়ার হোক বা ব্যক্তিজীবন–কিছুই গতানুগতিক নয় তাঁর ক্ষেত্রে। ২০১৮-য় তিনি ঘোষণা করেন টম হ্যাংকস অভিনীত বিখ্যাত ছবি ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর রিমেক রাইট কেনার কথা। প্রসঙ্গত, ১৯৯৪-এ নির্মিত প্যারামাউন্ট পিকচার্স-এর এই ছবি সে বছর অস্কারে বেশ ক’টি পুরস্কার জিতে নেয়। যার মধ্যে এ আলোচনায় যেটা প্রথমেই বলার, ছবির মুখ্য ভূমিকাভিনেতা টম হ্যাংকসের সেরা অভিনেতার পুরস্কার ঝুলিতে পুরে নেওয়ার বিষয়টি। চমকদার বা চমৎকার আমির সেই জুতোতেই পা গলিয়েছেন ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর ভারতীয়-করণের মাধ্যমে। নিঃসন্দেহে ‘লাল সিং চাড্ডা’ আমিরের কেরিয়ারের পক্ষে এক বড় চ্যালেঞ্জ, সে যতই তিনি হিন্দি ফিল্মি দুনিয়ায় এক ব্যতিক্রমী অবস্থানে থাকুন না কেন ! ২০১৯-এর ১৪ মার্চ নিজের ৫৪তম জন্মদিনে ছবির নাম ও এর নির্মাণ সংক্রান্ত প্রোজেক্টটির অফিসিয়াল ঘোষণার মধ্য দিয়ে ‘লাল সিং চাড্ডা’-র শুভ উদ্বোধন করেন আমির। সেদিন আমিরের সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী (এখন প্রাক্তনী) ও সহ-প্রযোজক কিরণ রাও। প্রসঙ্গত, তখনই জানা যায় ‘লাল সিং চাড্ডা’ পরিচালনা করছেন অদ্বৈত চন্দন, যিনি এর আগে আমিরের ‘সিক্রেট সুপারস্টার’ পরিচালনা করেছেন।
‘ফরেস্ট গাম্প’-এর মূল কাহিনিকার উইনস্টন গ্রুম। চিত্রনাট্য লেখেন এরিক রথ। ইনিও অস্কার জেতেন এই ছবিকে ঘিরে। এবার দেশীয় ‘ফরেস্ট গাম্প’, অর্থাৎ ‘লাল সিং চাড্ডা’-র কথা। বলিউডের একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান ও ক্ষমতাশালী অভিনেতা, প্রযোজক ও চিত্রনাট্য লেখক অতুল কুলকার্ণি ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর চিত্রনাট্যের হিন্দি রূপান্তর করেন। প্রসঙ্গত, ভারতের বেশ কয়েকটি প্রাদেশিক ভাষাতেই লেখালেখি করেন তিনি। বছর দশেক আগে ‘লাল সিং চাড্ডা’-র চিত্রনাট্য লেখার কাজটি করেছিলেন অতুল। সেটা আমির জানতেন। জানতেন, কিন্তু, অতুলের লেখার ওপর ভরসা ছিল না তাঁর।
কয়েকবছর পরের কথা–আমির কী ভেবে চিত্রনাট্যটি পড়েন এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেন ছবিটি করার। এক সাক্ষাৎকারে অতুল স্বয়ং এই তথ্য জানিয়েছেন। এরই সঙ্গে জানা যায়, তারপর আরও ৭-৮ বছর কেটে যায় ছবির রিমেক রাইট পাওয়ার ক্ষেত্রে। শেষে একদিন প্রতীক্ষার অবসান। গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে লস এঞ্জেলেস উড়ে যান আমির প্যারামাউন্ট-এর সঙ্গে বাকি অফিসিয়াল প্রস্তুতিপর্ব সেরে নিতে। এককথায় বহু বছরের আগু-পিছু এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভারতীয় দর্শকের সামনে আসার পথে পা রাখে আমিরের ‘লাল সিং চাড্ডা’।
ছবি প্রযোজনায় আমির খান প্রোডাকসন্স-এর সঙ্গে আছে ভায়াকম এইটটিন স্টুডিওজ ও প্যারামাউন্ট পিকচার্স। আমির ছাড়াও অভিনয় করছেন করিনা কাপুর ও দক্ষিণী সুপারস্টার নাগা চৈতন্য। ‘লাল সিং চাড্ডা’-র হাত ধরেই বলিউড ডেবিউ করছেন চৈতন্য। শোনা যাচ্ছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি এ ছবিতে। চৈতন্য এটাও জানেন, এই মুহূর্তে তাঁর ভক্তরা ‘লাল সিং চাড্ডা’ দেখার আগ্রহে ছটফট করছে। তবে, এক অস্কার-জয়ী ছবির রিমেকে কাজ করছেন, সে হিসেবে মোটেই উজ্জীবিত নন তিনি। চৈতন্যর কথায়, ছবির নির্মাতারা ভারতীয় সংস্কৃতি ও চেতনাকে মিলিয়েছেন মূল কাহিনির ভাবনার সঙ্গে। সেটাই তাঁর কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে। দক্ষিণী ছবিতে তাঁর অভিনয় দেখেই আমির চৈতন্যর কথা ভাবেন। সেইদিক থেকে আমিরের অফার এবং বলিউডে খাতা খোলার সুযোগ পেয়ে খুশি তিনি।
আমির, করিনা, চৈতন্য ছাড়াও এ ছবিতে অভিনয় করেছেন পঙ্কজ ত্রিপাঠি, মোনা সিং, শরমন যোশী, মানব ভিজ, অমর তালওয়ালা, যোগী বাবু, মানব গোহিল প্রমুখ। সিনেমাটোগ্রাফি সেতু। সম্পাদনা হেমন্তী সরকার। মিউজিক প্রীতম। জানা গেছে দেশের ১০০টির বেশি লোকেশনে শুটিং হয়েছে এ ছবির। শুটিং শুরু হয় ২০১৯-এর অক্টোবরে। অতিমারী পরিস্থিতির কারণে বেশ কিছুদিন শুটিং বন্ধ রাখতে হয়। ফলে, ছবির মুক্তিও পিছিয়ে যায়। পরিকল্পনা মাফিক ২০২০-র ডিসেম্বরে ‘লাল সিং চাড্ডা’-র আসার কথা ছিল দর্শক দরবারে। সেটা পিছিয়ে গিয়ে হলো এ বছরের ১১ আগস্ট। ছবির বাজেট ১৮০ কোটি টাকা।
রিমা কাতগির একজন পরিচালন সহকারী হিসেবে ‘হানিমুন ট্রাভেলস প্রাইভেট লিমিটেড’ ছবিতে কেরিয়ার শুরু করেন অদ্বৈত। ‘তারে জমিন পর’-এ তিনি ছিলেন সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার। কিরণ রাওয়ের পরিচালিত ‘ধোবিঘাট-এ ছিলেন কাস্টিং ডিরেক্টর ও পোস্ট প্রোডাকশন সুপারভাইজার। এরপর আরও নানা ধরনের দায়িত্বের কাজ সামলানোর পর অদ্বৈত প্রথম বড় সুযোগটা পান আমির খানের সৌজন্যেই। আমির তাঁকে ‘সিক্রেট সুপারস্টার’ পরিচালনার সুযোগ দেন। এ ছবির চিত্রনাট্যও অদ্বৈতরই লেখা। ‘সিক্রেট সুপারস্টার’ বাণিজ্যিক সাফল্যের চরম নিদর্শন রাখার পাশাপাশি সমালোচকদের প্রশংসাও অর্জন করে। এহেন অদ্বৈতর হাতে ‘লাল সিং চাড্ডা’-র রূপ কতটা খুলবে, সেটা দেখার অপেক্ষায় সকলেই। আর আমির ভক্তরা অপেক্ষা করছেন আমিরের নয়া চমকের জন্য !
ফরেস্ট–রূপকথার মতো জীবন নয় তার। নাকি সে নিজেই লেখে নিজের অরূপকথার জীবন। সমাজের রুটিন চোখে চেহারা ও কথাবার্তা, আচরণে অস্বাভাবিক (?) ফরেস্টের একমাত্র বন্ধু জেনি। ফরেস্ট ফুটবল খেলে, মিউজিক ব্যান্ডে যুক্ত হয়–যোগ দেয় আর্মিতে এবং আরও নানা কর্মকান্ড ঘিরে থাকে তাকে। আর্মিতে যোগদান, ভিয়েতনামের যুদ্ধ, নাসা ইত্যাদি ঘুরে যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলনে অংশ নেওয়া–সতত পরিবর্তনশীল তার যাপন। বিচিত্র পথগামী ফরেস্ট জীবনকে চেটেপুটে খায় নিজের শর্তে। এহেন ফরেস্টের দিশি রূপ লাল সিং চাড্ডা। সম্ভবত, আমাদের দেখা টম হ্যাংকসের ফরেস্টকে মাথা থেকে বের করেই মৌলিক সৃষ্টি লাল সিং চাড্ডাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আমি অভিনেতা আমির খানকে এতটুকু ছোট না করেই কথাটা বলছি।
বিষয়টা আসলে দৃষ্টিভঙ্গির। প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করে একটি বাণিজ্যসফল ছবি বানাতেই হবে টিম আমির খানকে। প্যারামাউন্ট বা ভায়াকম–যারাই থাক, আমির যেখানে, সেখানে তিনিই বস। যে দর্শনের প্রেক্ষিতে উইনস্টনের কলমে ফরেস্টের জন্ম, যে গভীর ও সূক্ষ অনুভবে টম হ্যাংকস চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তোলেন। সেই দর্শন নিয়ে ছবির ব্যবসা করার সাহস আছে কী আমির খান বা বলিউডের বাকিদের ? লাল সিং চাড্ডাকে আমির তাঁর মাপেই বানিয়ে নেবেন, চিত্রনাট্যে দখলদারি থেকে অভিনয়ে, সেটাই স্বাভাবিক। সেই হিসেবেই করিনা বা নাগা চৈতন্যর অন্তর্ভুক্তি। ভারতীয় দর্শক আমির-করিনার জুটিতে একটি সম্পূর্ণ বিনোদনধর্মী ছবি দেখতে হলে যাবেন। শুধু আমাদের মতো যারা আচ্ছন্ন ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর দর্শন অভিজ্ঞতায়, তাদেরই একটু অসুবিধা। তবে, সে আর ক’জন ? আমির আমাদের হিসেবে রাখেন না।