ফুলের নাম লিলি
একজন কিংবদন্তী অভিনেত্রী তিনি। বাংলা ও হিন্দি–দুই সিনেমার ক্ষেত্রেই ওঁর অভিনয় সমাদৃত। অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তীর স্থান আম দর্শকের হৃদয়ে। তাঁর সময়ের পক্ষে অনেকটাই ব্যতিক্রমী লিলি চক্রবর্তীর স্বাভাবিক অভিনয়ধারা এককথায় চমৎকৃত করে আজও। বলা যায়, সেই নিরিখেই আজও অপরিহার্য তিনি–সিনেমার পর্দা থেকে টিভি সিরিজ। লিখেছেন সুচেতনা বন্দোপাধ্যায়।
স্বপ্ন দেখার দিন
তাঁর ছোটবেলায় পাড়ায় স্ক্রিন টাঙিয়ে সিনেমা দেখানো হতো। মূলত সেখানে দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকতো কুলিকামিনরা। তখন দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সেই সিনেমা দেখতেন তিনি। আর মনে মনে ভাবতেন, যদি ওইরকম পর্দায় নিজেও হেঁটে যেতে পারতাম ! সেই ভাবনা একদিন সত্যি হল। পর্দায় দেখা গেল লিলি চক্রবর্তীকে। সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, সুশীল মুখোপাধ্যায়, মৃণাল সেন থেকে শুরু করে গুলজার, হৃষিকেশ মুখার্জি এবং ঋতুপর্ণ ঘোষ, কৌশিক গাঙ্গুলি, সৃজিত মুখার্জি, সুমন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সমস্ত নামী পরিচালকদের ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। বাংলা অভিনয় জগতে স্বতন্ত্র তিনি। আর দর্শকের মন জুড়ে আছেন প্রায় ৬৩ বছর।
যাত্রা হল শুরু
লিলি চক্রবর্তীর জন্ম ওপার বাংলায়। তাঁর বাবা ছিলেন বেশ বড় ব্যবসায়ী। দেশভাগের পর এদেশে চলে আসেন। কিন্তু এখানে এসে আর ব্যবসা দাঁড় করাতে পারলেন না। খুবই আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছিল। সে সময় তিনি বেশ কিছুদিন মধ্যপ্রদেশে মামাবাড়িতে থাকতেন। সংসারের হাল ধরতে তাঁর মা দীপালি চক্রবর্তী মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন। দীপালি চক্রবর্তী অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নান্দীকারেও অভিনয় করেছেন। মায়ের পাশাপাশি তাঁর মেজদিও অভিনয় শুরু করেন। তিনি অফিস ক্লাবে পেশাদার অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করতেন। এরপর মধ্যপ্রদেশ থেকে ফিরে তিনিও দিদির সঙ্গে ক্লাব থিয়েটারে যোগ দেন। শুরু হল অভিনয়ের জয়যাত্রা ।

পর্দায় আত্মপ্রকাশ
লিলি চক্রবর্তী যে নাটকে অভিনয় করছিলেন, সেই নাটকের পরিচালক ছিলেন কুণাল মুখার্জি। তিনি একদিন অভিনেত্রীর কাছে জানতে চান, তিনি সিনেমায় অভিনয় করতে রাজি কিনা। এমন প্রস্তাব তো হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। কুণাল মুখার্জি তাঁর দাদা কণক মুখার্জির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন লিলিকে। তিনি পরদিন রাধা স্টুডিওতে যেতে বলেন। লিলি বাবার সঙ্গে শাড়ি পরে হাজির হন সেখানে। তখন ‘ভানু পেল লটারি’র শুটিং চলছিল। কমল মিত্র ও জহর রায়ের সঙ্গে অভিনয় করতে হবে, টাইপিস্টের একটা ছোট ভূমিকায়। অভিনয় তো করেছেন, কিন্তু, কেমন হলো তা বুঝতে পারছিলেন না। মনে একটু সংশয় ছিল, ঠিক হল কিনা। শুটিংয়ের পরদিন কুণাল মুখার্জি তাঁকে জানান, “দাদা আমাকে খুব বকছিলেন। বললেন, মেয়েটাকে আগে আনতে পারলি না ? তাহলে ওকেই নায়িকা করতাম।” শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন লিলি। এভাবেই পর্দায় কাজ শুরু হয় তাঁর। ১৯৫৮ সালে প্রথম পর্দায় আত্মপ্রকাশ।

কমলা ও উমার আখ্যান
সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় লিলি চক্রবর্তীর প্রথম ছবি ‘জন অরণ্য’। যদিও এর অনেক আগেই একবার তিনি ওঁর বাড়িতে ডেকেছিলেন লিলিকে। তখনও জানতেন না, সত্যজিৎবাবু কত বড় মাপের পরিচালক! নামই শোনেননি। ওঁর বাড়ি যাওয়ার পর সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায় তাঁকে ডুরে শাড়ি পরিয়ে চুল বেঁধে দিয়েছিলেন। আর পরিচালক তাঁর অনেক ছবি তুলেছিলেন। এরপর তিনি নিজেই অভিনেত্রীকে জানান, “দেখো আমি যে চরিত্রের জন্য তোমার লুক টেস্ট করলাম সেই চরিত্রে এরমধ্যে একজনের সঙ্গে কথা বলেছি। ওর স্কুলে কিছু সমস্যা হচ্ছে। যদি ও না করে তাহলে তোমাকে নেব।” উত্তরে লিলি জানান, “ঠিক আছে।” পরে বুঝেছিলেন,কাকে বলেছেন, ‘ঠিক আছে’। সেই ছবির নাম ছিল ‘অপুর সংসার’। আর যিনি প্রথম পছন্দের ছিলেন, তাঁর নাম শর্মিলা ঠাকুর। শেষ পর্যন্ত আর সেই ছবিতে অভিনয় করা হয়নি তাঁর। যদিও তা নিয়ে কোনও আক্ষেপ ছিল না।
এর বেশ কিছুদিন পর, তিনি তখন ‘চুপকে চুপকে’ ছবির শুটিংয়ের জন্য মুম্বইতে। সে সময় ফের সত্যজিৎ রায় চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করেন তাঁর সঙ্গে। চিঠি পেয়েই কলকাতায় চলে আসেন। কিন্তু এরপরে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর চুল। বিজয়া রায় তাঁকে বলেন, “তোমার সেই কোমর ছাপানো চুল কোথায় গেল ?” সত্যজিৎ রায় বলেন, “ফুলেশ্বরী ছবিতেও তো একমাথা চুল ছিল।” লিলি তখন আস্তে আস্তে জানান, “ওটা নিজের চুল নয়, উইগ।” ভেবেছিলেন, তখনই হয়তো ছবি থেকে বাদ পড়বেন। কিন্তু না, সত্যজিৎ বাবু হেসে বললেন, “কে এমন উইগ বানালো, যে আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলো ?” উত্তরে লিলি, “পিয়ার আলি।” সঙ্গে সঙ্গে পিয়ার আলিকে ডেকে উইগের অর্ডার দেন। কিন্তু এত খুঁতখুঁতে ছিলেন, বারবার মেকআপ রুমে গিয়ে লিলির মাথায় পরানো উইগটা পেনসিল দিয়ে নাড়িয়ে দেখেছেন, কিছু বোঝা যায় কিনা।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক শঙ্করের উপন্যাস ভিত্তিক ছবি ‘জন অরণ্য’য় কমলার চরিত্রে সেই উইগ পরেই অভিনয় করেন লিলি। এই ছবির প্রায় ১৫ বছর পর পরিচালকের ‘শাখা প্রশাখা’য় অভিনয় করেন উমার চরিত্রে। আগেরবার উইগ ব্যবহার করলেও, এই ছবিতে কোনও হেয়ার ড্রেসার বা মেকআপম্যান ছিলেন না। মমতা শংকর ও লিলি–দুজনে দুজনকে চুল বেঁধে দিতেন। নিজেরাই পাউডার মেখে, ভ্রূ এঁকে নিতেন। টানা ২০ দিন এই মেকআপেই শুটিং করেছেন।

একদিন আচানক
‘জননী’ নামে একটা ছবিতে সুলোচনা দেবীর সঙ্গে অভিনয় করেন লিলি। ওঁর স্বামী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সম্পূর্ণ বিষ্ণুপুরাণ’ নামে একটা হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দেন। তখনই মুম্বইতে পাড়ি দেন তিনি। মুম্বইতে কাজ করছেন। সেখানেই একদিন আলাপ মৃণাল সেনের সঙ্গে। সুযোগ আসে একটা ধারাবাহিকে কাজ করার। প্রথম দিনের শুটিংয়ের দৃশ্য ছিল টেলিফোনে হিন্দিতে কথোপকথন। কথা শেষ হওয়ার পর একজন হিন্দিভাষীকে পরিচালক জিজ্ঞাসা করেন, লিলির উচ্চারণ ঠিক আছে কিনা। উনি বলেন, একদম ঠিক আছে। আসলে ছোটবেলায় বেশ কিছুদিন মধ্যপ্রদেশে থাকার জন্য হিন্দিতে ভালোই কথা বলতে পারতেন লিলি। তাছাড়া এই ধারাবাহিকের আগে বেশ কয়েকটা হিন্দি ছবিতেও কাজ করেছেন তিনি। মৃণাল সেনের দুটি ধারাবাহিকে কাজ করার পর আসে ‘একদিন আচানক’ ছবিতে কাজ করার সুযোগ। শাবানা আজমির সঙ্গে সেই ছবি তো সুপার হিট।

চোখের বালি
ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’তেও অভিনয় করেন তিনি। লিলির মতে, তাঁর স্ক্রিপ্ট এত সুন্দর করে লেখা থাকতো যে অভিনেতাদের আলাদা করে কিছু ভাবতে হতো না। ভাল হলে যেমন প্রশংসা করতেন, তেমনই খারাপ হলে বলতেন, খুব খারাপ হয়েছে। আবার টেক দে। ঋতুপর্ণ তাঁকেও ‘তুই’ করেই সম্বোধন করতেন। এ নিয়ে এক মজার ঘটনাও জানান। একদিন ‘চোখের বালি’র শুটিংয়ে পরিচালকের মা এসে হাজির। লিলি কৌতূহলবশে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, “আচ্ছা ঋতু কি আপনাকেও তুই করে বলে?” প্রশ্ন শুনে খুব হাসেন তিনি। উত্তরে বলেন, “ও খুব পাজি।”

আচানক ও মৌসম
মুম্বইতে থাকাকালীন একদিন ডাক পান পরিচালক গুলজারের। লিলি কেমন হিন্দি বলেন দেখার জন্য তিনি লিলিকে হিন্দিতে কথা বলতে বলেন। লিলির হিন্দি শুনে গুলজার প্রায় চমকে ওঠেন। জানান, এত ভাল হিন্দি বাঙালিরা খুব কম বলতে পারে। যেমন শর্মিলা ও রাখির উচ্চারণ শুনে বোঝা যায়, ওরা বাঙালি। যদিও জয়া বচ্চনের উচ্চারণে তা বোঝা যায় না। তখন লিলি মনে করিয়ে দেন, আসলে জয়ার মতো তিনিও ছোটবেলায় অনেক দিন মধ্যপ্রদেশে কাটিয়েছেন বলেই উচ্চারণে সমস্যা হয় না। সব ঠিকঠাক হওয়ার পর গুলজার তাঁকে বলেন, “আমি একজন প্রোডিউসারের ফোন নম্বর দিচ্ছি। আপনি তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলে নিন।” এই প্রস্তাবে সরাসরি ‘না’ বলে দেন লিলি। বলেন, “আমি নিজে থেকে কাউকে ফোন করব না।” এরপর গুলজার বলেন, “ঠিক আছে আমিই কথা বলে নিচ্ছি।” শেষ পর্যন্ত গুলজার পরিচালিত ‘আচানক’ ছবিতে অভিনয় করেন লিলি, নায়ক বিনোদ খান্নার বিপরীতে। সেটা ছিল ১৯৭৩ সাল। ১৯৭৫ সালে ফের গুলজারের ‘মৌসম’ ছবিতে অভিনয় করেন। সেখানে লিলির সহ অভিনেতা হিসেবে ছিলেন সঞ্জীব কুমার, শর্মিলা ঠাকুর।

বচ্চন আলাপ
হৃষিকেশ মুখার্জি পরিচালিত কমেডি ছবি ‘চুপকে চুপকে’-তে ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন এবং শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন লিলি চক্রবর্তী । এরপর হৃষিকেশ মুখার্জির আরেক বিখ্যাত ছবি ‘আলাপ’। এখানেও লিলি গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকায়, সহ অভিনেতা ছায়া দেবী, অমিতাভ বচ্চন ও রেখা। ‘আলাপ’ ছবির শুটিংয়ের সময় একদিন মেকআপ করে পরিচালককে দেখাতে গেছেন। পরিচালক তখন সেটের বাইরে বসে দাবা খেলছিলেন আর অমিতাভ বচ্চন পিছন ফিরে কথা বলছিলেন। পরিচালককে সাজ দেখিয়ে ফিরে আসছেন লিলি। তখন অমিতাভ বচ্চন বলেছিলেন, “কেয়া লিলিজি একসাথ কাম কিয়া। হ্যালো ভি নেহি বোলা। হাই ভি নেহি বোলা ওয়াপস চলি যা রহি হ্যায়!” খুব লজ্জা পেয়েছিলেন সেদিন লিলি।

নায়িকার ‘না’ ভূমিকায়
এতদিন ধরে, এত সাবলীল অভিনয় করার পরেও সেভাবে তাঁকে নায়িকার চরিত্রে পাওয়া যায়নি বলে খুব বেশি আক্ষেপ নেই তাঁর। জানান, নায়িকা হতে পারলে ভাল লাগতো। অনেক সময়ে সে সুযোগ এসেও ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি ও কারও কারও হস্তক্ষেপে তা আর হয়ে ওঠেনি। যেমন, শক্তি সামন্তের ছবির অফার ছেড়ে কলকাতায় আসেন ‘গৃহদাহ’ করবেন বলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বাদ পড়ে যান। তবে, তিনি মনে করেন চরিত্রাভিনেত্রী হলে অনেক রকমের চরিত্র করার সুযোগ থাকে। আর অভিনয় করতে এসেছেন যখন, তখন যে চরিত্র পাবেন তা ভাল ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারলেই অভিনেতা সফল বলে মত তাঁর।


‘উত্তম’ সান্ন্যিধ্য
পরিচালক সুনীল বন্দোপাধ্যায়ের ‘দেয়া নেয়া’ ছবির সময় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি নতুনই বলা যায়। মহানায়কের সঙ্গে সেই ছবিতে তিনিও ছিলেন। কিন্তু তিনি যে নতুন, তা কখনও বুঝতে দেননি উত্তমকুমার। এরপর ‘ভোলা ময়রা’ ছবিতে উত্তমকুমার নিজেই তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় লিলিকে চেয়েছিলেন। শুটিংয়ের সময় একটি দৃশ্যে উত্তম জড়িয়ে ধরেছিলেন লিলিকে। সেদিন সেটে ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী। লিলি অস্বস্তি বোধ করে সুপ্রিয়া দেবীকে বলেন, “দেখো উত্তমদা কী করছেন ?” উত্তম তখন বলেন, “ও কী বলবে? তুমি তো এখন আমার বউ!”

পুরস্কার ও স্বীকৃতি
দর্শকের প্রশংসাই তাঁর কাজে উৎসাহ জোগায়। তাঁদের ভালবাসাই কাজে অনুপ্রেরণা জোগায়। তবে, পুরস্কার পেলে তো ভালো লাগেই। ‘সাঁঝবাতি’ ছবির জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন লিলি। পেয়েছেন ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোশিয়েশন পুরস্কার। নিজের আত্মজীবনী মুলক বইও লিখেছেন। সেই বইয়ের নাম ‘আমি লিলি’। সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত সেই বইয়ের অনুলিখন করেছেন দীপংকর ভট্টাচার্য ও অমর দেবরায়। নিজের জীবনের ওঠাপড়া, ভালমন্দ অভিজ্ঞতা সব কিছু অকপটভাবে প্রকাশ করেছেন তিনি এই বইতে। অকপটতা–এটাই তিনি। লিলি ফুলের মতোই সরল, স্নিগ্ধ ও সতেজ।