বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। বাংলা ছবির সেরা অভিনেতাদের অন্যতম তিনি। কাজ করেছেন সব মাধ্যমেই। অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখেছেন দেবজিৎ সাহা।
আমাদের সমাজে বেশিরভাগ বাবা-মায়েরই ধারণা, তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। নতুবা সমাজে তাদের লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। ছয়ের দশকের পক্ষে যথেষ্ট বিরল হলেও, এমনই এক পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পেশাকে চিরকালের মতো বিসর্জন দিয়ে অভিনয় জগতে চলে আসা মানুষটি হলেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৯শে নভেম্বর। মৃত্যু ২০০৭-এর ৫ই জুলাই। ভাল ছাত্র ছিলেন শুভেন্দু। তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল সাহিত্য। ভালবাসতেন পাহাড় সম্পর্কে বই পড়তে। আর ছিল অভিধান পড়ার শখ! শব্দের উচ্চারণ নিয়ে জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। একটু-আধটু কবিতা লিখতেন, কখনও বা গদ্য। কিন্তু ঠাকুরদা ডাক্তার ছিলেন বলে বাবার ইচ্ছেয় শুভেন্দুকে ডাক্তারি পড়তে হলো। কিছুদিন পুরসভার হাসপাতালে চাকরি করে পেশায় ইতি টানেন তিনি।
অবশ্য ইতি টানার বীজ বপন হয়েছিল সেই কোন স্কুলে পড়ার সময়ই! সেই সময় শ্রীরঙ্গমে শিশির ভাদুড়ীর ‘মাইকেল মধুসূদন’ নাটকটি দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন শুভেন্দু। তখনই অভিনয় করার তীব্র ইচ্ছা সঞ্চারিত হয় মনে। ডাক্তারি পড়তে পড়তেই আইপিটিএ-তে যোগ দেন। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যাকে তিনি গুরু মানতেন। সাল ১৯৬৫, আইপিটিএ-র মঞ্চে তাঁকে দেখে পরিচালক মৃণাল সেন শুভেন্দুর কথা ভাবেন, তাঁর ‘আকাশকুসুম’ ছবির জন্য। ‘আকাশকুসুম’ মুক্তি পাওয়ার পরই পরিচালকদের নজরে পড়েন শুভেন্দু। সে তালিকায় ছিলেন সত্যজিৎ রায়ও। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর শুভেন্দুকে ডেকে নিলেন সত্যজিৎ রায়। তারপরই মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে প্রথম অভিনয় তাঁর ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে। এরপর সত্যজিতেরই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে অভিনয় করলেন শুভেন্দু, সঙ্গী রবি ঘোষ, শমিত ভঞ্জ ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া, ‘চিড়িয়াখানা’-র পর আবারও তিনি হয়েছেন মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গী, সাহিত্যিক শঙ্করের লেখা বিখ্যাত ছবি ‘চৌরঙ্গী-তে!
তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হলো ‘এখনই’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর আ্যসিস্ট্যান্ট’, ‘বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা’, ‘প্রথম কদম ফুল’, ‘হংস মিথুন’, ‘অনিন্দিতা’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘পঞ্চশর’, ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’, ‘জীবন রহস্য’, ‘বহুরূপী’, ‘কুহেলী’, ‘আঁধার পেরিয়ে’, ‘গণশত্রু’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘আবার অরণ্যে’, ‘লাল দরজা’ এবং ‘চৌরঙ্গী’–যেখানে ঘটেছে নায়ক থেকে চরিত্রাভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের এক অন্তহীন পথচলা। ‘অনিন্দিতা’ ছবিতে তাঁর লিপে কিশোর কুমারের ‘ওগো নিরুপমা’ তো অল টাইম হিট। পরবর্তীকালে ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে পাই আমরা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে। ‘ঝিনুকের বাবা’ হিসেবে তিনি ছিলেন বহু আলোচিত ‘দহন’ ছবিতে। এছাড়াও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘লাল দরজা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হন শুভেন্দু।
সন্দীপ রায় পরিচালিত, সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘ডাঃ মুন্সীর ডায়েরী’ অবলম্বনে তৈরি টেলিফিল্মে তিনি অভিনয় করেন ডাঃ মুন্সীর ভূমিকায় ! অভিনেতা হিসেবে শুধু সিনেমা বা টিভি নয়, তাঁর ব্যাপ্তি ছিল মঞ্চেও। বেশ কয়েকটি থিয়েটারে অভিনয় করেছেন শুভেন্দু চ্যাটার্জি–যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আশির দশকে মঞ্চস্থ হওয়া জনপ্রিয় নাটক ‘বিলকিস বেগম’, ‘বিবর’, ‘অমর কণ্টক’, ‘কালবৈশাখী’, ‘বধূবরণ’ প্রভৃতি। তিনি বেশ কয়েকটি যাত্রাপালাতেও অভিনয় করেছেন। উল্লেখ্য, ‘এমন একটা মানুষ চাই’, ‘নকল স্বামীর ঘর’!
ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের অনুরাগী ছিলেন শুভেন্দু। নিয়মিত শুনতেন শাস্ত্রীয়সঙ্গীত। একবার একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে শুভেন্দু ধরা পড়ে যান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে, যে, তিনি সুকণ্ঠী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন গান রেকর্ড করার। শুভেন্দু ভেবেছিলেন, পার্টিতে তো এমন অনেক কথাই হয়, এই প্রস্তাবও নিশ্চয়ই সেই রকমই। কিন্তু কয়েকদিন পর এইচএমভি থেকে ফোন করলেন সন্তোষ সেনগুপ্ত, বললেন, ‘হেমন্ত বলছিল, আপনি নাকি ভাল গান করেন?’ তারপরই এইচএমভি থেকে শুভেন্দুর কণ্ঠে প্রকাশিত হলো সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা বিখ্যাত কবিতা ‘একটি মোরগের কাহিনী’ কবিতাটিতে সুর দিয়েছিলেন অজয় দাস। এছাড়াও তিনি গেয়েছিলেন অজয় দাসের কথা ও সুরে ‘আশা নদীর কূলে’ এবং আনন্দ মুখোপাধ্যায়ের কথা ও অজয় দাসের সুরে ‘সেই পলাতক পাখি’।
পেশাদারি ভাবে তিনি ডাক্তারি করেননি ঠিকই, তবে, পুরোদস্তুর ডাক্তারিটা জীবন থেকে ঝেড়েও ফেলতে পারেননি শুভেন্দু।‘বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা’ ছবির শ্যুটিংয়ের সময় গঙ্গোত্রী থেকে যমুনোত্রী পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তা হেঁটে যেতে হয়েছিল শুভেন্দু ও পুরো শ্যুটিং ইউনিটকে। সেই সময় বহু পাহাড়ী মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। অনেকেই শুভেন্দুর কাছ থেকে ওষুধ নিতেন। তাঁদের কাছে তখন তিনি অভিনেতা নন, ডাক্তারবাবু হিসেবেই পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একটা সময় তাঁর ওষুধের ভাণ্ডার শেষ হয়ে আসে। এ দিকে তখনও শ্যুটিং শেষ হয়নি।
এমনই একদিন এক বৃদ্ধ তাঁর কাছে ওষুধ নিতে এলেন। বৃদ্ধর পায়ে ছেঁড়া ব্যান্ডেজ খুলে আঁতকে উঠলেন শুভেন্দু! এ তো পা কেটে বাদ দিতে হবে! কিন্তু সে সময় তা সম্ভব নয়। তিনি ক্ষত পরিষ্কার করে সালফাডায়জিন ট্যাবলেট গুঁড়ো লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। তাঁর মনে কিন্তু বৃদ্ধর আরোগ্য নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। শ্যুটিং শেষ করে ফেরার পথে দেখলেন সেই বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে একবাটি ছাগলের দুধ। তাঁর পায়ের ক্ষত সম্পূর্ণ ঠিক হয়ে গিয়েছে। ডাক্তারবাবুকে দেওয়ার মতো পয়সা নেই, তাই বৃদ্ধ ছাগলের দুধ এনেছেন। ভালোবাসার দান, সেই দুধ খেয়েছিলেন শুভেন্দু।
ওঁর ছোট ছেলে নিতান্তই কোলের শিশু তখন। ঝিনুক দিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন ঠাকুমা। বেকায়দায় দুধ শিশুর শ্বাসনালীতে ঢুকে যায়। দমবন্ধ অবস্থায় নীল হয়ে যায় ছেলে। শুভেন্দু দৌড়ে এসে শিশুপুত্রকে থাবড়ে, প্রেশার দিয়ে দুধ বের করেন। এরপর শুভেন্দু তাঁর মা’কে শুধু বলেছিলেন, “কাল থেকে এ বাড়িতে ঝিনুক বন্ধ। ফিডিং বটলে খাওয়াবে। আরে, খিদে পেলে কুকুরের বাচ্চাও কেড়ে খায়। এ তো মানুষের বাচ্চা! খিদের কথা বলতে পারবে, বোঝাতে পারবে।”
একটা সময় বাংলা ছবির নায়ক বলতে উত্তম-সৌমিত্র-শুভেন্দু–পরপর এভাবে নাম নিতে অভ্যস্ত ছিল বাঙালি। কিন্তু, শুভেন্দুর ক্ষেত্রে কোনও একটা সময় কোথাও যেন তার কেটে গেল! ‘চৌরঙ্গী’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’-র মতো ছবির জন্য যাঁকে আজীবন মনে রাখা যায়, সেই শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়েকে কি আমরা একসারি পিছনে ঠেলে দিলাম? হয়তো তাই ! নাকি তিনি নিজেই সরে গেলেন ! কারণ যাই হোক, এ সত্যি মানতেই হবে, সেভাবে তাঁকে পরের দিকে না পাওয়াটা আমাদের অপ্রাপ্তি। আক্ষেপের কথা, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটিকে নিয়ে আজই বা সেরকম আলোচনা আর হয় কোথায়?!
ছবি ও তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট