‘শেষ পাতা’য় কী আছে, দেখতেই হবে আপনাকে
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। বাংলা নববর্ষে মুক্তি পেয়েছে অতনু ঘোষের ছবি ‘শেষ পাতা’। ছবি দেখার অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন চারুবাক।
লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকার সময়ই বাল্মীকির (প্রসেনজিৎ) অভিনেত্রী স্ত্রী খুন হয় এবং বিবস্ত্র অবস্থায় ময়দানে পাওয়া যায় তাকে। তখন থেকেই এক ধরনের একাকীত্ব গ্রাস করে বাল্মীকিকে। সমাজজীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন তিনি। পানাসক্তি আর নারীসঙ্গেই দিন রাত কাটে তাঁর এখন। বাল্মীকির জীবনের বেদনার অন্ধকারে ঢাকা বিষয়টিকেই বই আকারে ছাপিয়ে বাজারে বিক্রি করতে চায় এক প্রকাশক। প্রকাশক ভদ্রলোকটির কাছ থেকে লেখার জন্য মোটা টাকা অগ্রিম নিয়েও এক কলম লিখতে পারেন না বাল্মীকি। তাঁর ‘রাইটার্স ব্লক’-এর অন্যতম কারণ বাল্মীকির প্রতি তাঁর চারপাশের মানুষের নেতিবাচক মনোভাব।
অগত্যা প্রকাশক ঋণ রিকভারি এজেন্ট শৌনককে (বিক্রম চ্যাটার্জি) নিয়োগ করে, বাল্মীকির কাছ থেকে লেখাটি আদায় করতে। এদিকে সে বেচারির জীবনও চলছে ধার করে–ছোট ভাইকে পড়ানোর জন্য ধার! প্রাথমিক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে, শৌনক তার এক বান্ধবী ডিভোর্সি মেধাকে (গার্গী রায়চৌধুরী) পাঠায় বাল্মীকির কাছে। বিষয়টি এমন, বাল্মীকি বলবেন, শুনে শুনে লিখবে মেধা। এরপর বাল্মীকি আর মেধার যাপন–নানা জটিল মানসিক সংকটে, স্তরে স্তরে গভীর ও সূক্ষ টানাপোড়েনে অদ্ভুত ও ব্যাখ্যাহীন এক রসায়ন তৈরি করে। কখন যেন পর্দার এই রসায়নে দর্শক অজান্তেই সম্পৃক্ত হয়ে যান।
বিভিন্ন দৃশ্যে সুন্দর সংলাপ ব্যবহারের পাশাপাশি সিনেমার নিজস্ব ভাষাকে ব্যবহার করে এমন কিছু বিমূর্ত মুহূর্ত তৈরি করেন অতনু এখানে, যা দেখে সিনেমাপ্রেমী দর্শক আক্ষরিক অর্থেই আপ্লুত হন। তেমনই একটি মুহূর্ত হলো প্রসেনজিৎ যখন একটু মাতাল অবস্থায় গেয়ে ওঠেন–’ধিনতাকের ব্যাটা তিন তাক/ মা রেঁধেছে পুঁই শাক’। এই দৃশ্যে প্রসেনজিৎ নিজের (প্রবীণ বাল্মীকি হয়ে) শরীরকে দুমরিয়ে মুচড়িয়ে এক নতুন মানুষ হয়ে ওঠেন। পুরো ছবি জুড়েই অবশ্য প্রসেনজিৎ দর্শকের নজরে থাকেন নিজের চেহারা ও অভিব্যক্তির অস্বাভাবিক বদল ঘটিয়ে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, অবিন্যস্ত কাঁচা-পাকা চুল এবং পুরো চেহারাতেই দারুন এক ভাঙচুর।
হাসপাতালে হঠাৎ ক্ষেপে ওঠার অভিনয়ও সহজ ছিল না। চরিত্রের প্রতি কতটা নিষ্ঠা থাকলে এমনটি করা সম্ভব অনুজরা একটু ভাববেন কি? তাঁর সঙ্গে সমানে ক্রিকেটীয় ভাষায় যাকে বলে সপাটে বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারিতে বল পাঠিয়েছেন গার্গীও। মেধার নিজের জীবনের দোলাচল অবস্থা এবং বাল্মীকির সান্নিধ্যে এসে নিজেকে অনেকদিন পর মেলে ধরার কাজটি ব্যক্তিত্ব বজায় রেখেই করেছেন তিনি। সবার ওপর রয়েছে তাঁর নিজের গাওয়া অসাধারণ দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। অতনুকে ধন্যবাদ গান দুটি সঠিক সিচুয়েশনে ব্যবহারের জন্য। ‘আমার জ্বলেনি আলো’ এবং শেষ পর্বে ‘আমার যে সব দিতে হবে’–মেধার জীবনের দুটি জীবন-ঘন মুহূর্তেই এনেছেন পরিচালক।
সংলাপ লেখায় অতনুর কলম শুধু দার্শনিক নয়, চলমান জীবন থেকেই ভাষাকে উত্তীর্ণ করে দেন এক নান্দনিকতায়। যেমন বাল্মীকির মুখেই শুনি ‘লেখক নিছক কলমপেশা মজুর’ বা ‘নিজের আলো নিজে জ্বালান, তারপর মল্লিকা মালতী হয়ে চারদিকে নাচুন’ কিংবা দেনাশোধের প্রসঙ্গে ‘লেজারবুকে কিছু রয়েই যায়, দেনা শোধ হয় না’ ! ‘শেষ পাতা’র ট্র্যাজিক এবং হৃদয়ছোঁয়া মুহূর্ত হলো, যখন বাড়ির কাজের মেয়ে (নাকি বাল্মীকির রতসঙ্গিনী) লেখার শেষ কটি পাতা মেধার হাতে তুলে দেয়! মেধার কাছে সে এক কান্নাভেজা শব্দহীন হাহাকারের মুহূর্ত। অতনু কী অসাধারণ সাবলীলতার সঙ্গে মুহূর্তটি উপস্থিত করেন!
এই ছবিতে তাই যেন পুরনো অতনুকে পাই না। তিনি যেন নিজেকেও অতিক্রম করে যান। দেবজ্যোতি মিশ্রর খুবই নিচু গ্রামে আবহ ‘শেষ পাতা’-কে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায়। আর হ্যাঁ, বিক্রম চ্যাটার্জিকেও রিকভারি এজেন্টের চরিত্রে একেবারে নতুনভাবে পাওয়া গেল অতনুর উপস্থাপনায়। তার প্রেমিকা দীপা হয়েছেন রায়তী ভট্টাচার্য। সহজাত, সাবলীল অভিনয়ে যেন পাশের বাড়ির মেয়ে। অতনু আবার প্রমাণ করলেন, গোয়েন্দা রহস্য বা প্রেম কাহিনির বাইরেও কিছু মানুষের যাপনে অস্বাভাবিকতা থাকে, যেখানে স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিকতার মধ্যে কিছু ধূসর জায়গা অবস্থান করে। সেগুলো এক্সপ্লোর করতে পারলে মানুষের জীবনের অনেক গভীরে পৌঁছানো যায়। সাবাস অতনু, আপনার জন্য থ্রি চিয়ার্স !!
পুনশ্চ : রুশ ভাষার মহান লেখক ফিওদর দস্তভয়স্কি নির্বাসন থেকে ফিরে তাঁর ‘জুয়াড়ি’ উপন্যাসটি লেখার জন্য অ্যানা নামে একজন স্টেনোগ্রাফারের সাহায্য নিয়েছিলেন। সেই অ্যানাকেই তিনি পরে বিবাহ করেন। ‘শেষ পাতা’-র বীজ যদি হয় এই কাহিনি, তাতে আপত্তির কিছু নেই। বঙ্গীকরণে তিনি খাঁটি বাঙালি।