Sunday, May 19, 2024
বিনোদন প্লাস স্পেশাললাইম-Light

নিভৃতবাসিনী সন্ধ্যাতারা

লিখেছেন অজন্তা সিনহা

সাংবাদিক হিসেবে তখন কিছুটা পরিচিতি তৈরি হয়েছে। অন্তত, কলকাতার বিনোদন ও সংস্কৃতি জগতের ক্ষেত্রে অনেকেই চেনেন। পারস্পরিক একটা শ্রদ্ধা ও ভরসার সম্পর্কও তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। সেই সময় কোনও এক উপলক্ষে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নেবার একটা উদ্যোগ নিতে হয়েছিল। এই উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারটা কী, পাঠকদের জানাই।  সেলিব্রিটি বা কিংবদন্তী মানুষজনের ক্ষেত্রে নানারকম প্রেক্ষিতে, নানাভাবে ফিচার পাতার পরিকল্পনা করি আমরা। তার মধ্যে একটি অবশ্যই তাঁকে কেন্দ্র করে বড় কোনও ঘটনা ঘটলে–কোনও বড় পুরস্কার, বিশেষ সম্মান প্রাপ্তি বা তাঁদের কর্মজীবনের রজতজয়ন্তী, সুবর্ণজয়ন্তী ইত্যাদি। এমন কিছু একটা প্রেক্ষিতেই আমি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম।

বহু পুরোনো কথা। তাই প্রেক্ষিত আর মনে নেই আজ। কিন্তু এটা ভুলিনি, আমার সে উদ্যোগ সফল হয়নি। ওঁর সামনে গিয়ে নতজানু হবো কোনও একদিন, সেটা আমার ভাগ্যে ঘটলো না। এক্ষেত্রে সাংবাদিক সত্তার চেয়েও বড় ছিল একজন সংগীতশিল্পী হিসেবে তাগিদ। পরিস্থিতির কারণে যতটুকু গানবাজনার চর্চা করি, তা বলার মতো নয়। তা সত্ত্বেও আর এক কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দে’র সাক্ষাৎকার নেওয়া এবং সেটা প্রকাশিত হওয়ার পর ওঁর প্রতিক্রিয়া, ‘ও তো গানটা জানে, তাই এত ভালো লিখেছে!’ সাংবাদিকতা আর সংগীতচর্চার মধ্যে কোনটা আগে, কোনটা পরে রাখবো–সারা জীবনের এই যন্ত্রণাময় টানাপোড়েনে মান্না দে’র ওই একটি কথা বড় আরামের কাজ করেছিল। বলা বাহুল্য, মান্না দে’র সার্টিফিকেটের জোরেই সাহস পেয়েছিলাম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকারের পরিকল্পনা করার।

না, কোনও অভিযোগ বা অভিমান প্রকাশের জন্য এই নিবেদন নয়। বরং উপলব্ধি ও অনুভবের আকুতি নিয়ে আমার সেদিনের ওই ব্যর্থতার ইতিহাসকে  বোঝার চেষ্টা করবো। কলকাতার এক প্রথমশ্রেণীর দৈনিকের পক্ষ থেকে ফোনে যোগাযোগ করেছিলাম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। ফোনটা ধরেছিলেন বিখ্যাত কবি ও গীতিকার শ্যামল গুপ্ত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী। ওঁর সঙ্গে আমার ফোনালাপ খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল সেদিন। একটি শর্ত রেখেছিলেন শ্যামল গুপ্ত আমার সামনে, যেটা পূরণ করলে আমি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার পেতে পারি। সেই শর্ত কী, সেটা থাক। শর্ত পূরণ করতে অক্ষম ছিলাম আমি। আমি যে সংস্থার কর্মী, সেখানেও কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। থাকে। অতএব ব্যর্থতা মেনে নেওয়া।

এই বিষয়ে পরে সংগীত জগতের অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছিলাম। দেখলাম, ঘটনাটা খুব অভিনব নয়। বিষয়টা সকলেরই জানা। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পুরো সংগীত জীবন জুড়ে শ্যামলবাবু একটি সুরক্ষা কবজের ভূমিকা পালন করেছেন। শ্যামল গুপ্তকে টপকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন মুষ্টিমেয় মানুষ। বিশেষত, সংবাদ মাধ্যমের জন্য কড়াকড়ি একটু বেশিই ছিল। অত্যন্ত প্রতিভাবান ও বুদ্ধিদীপ্ত মানুষটি সংবাদ মাধ্যমের ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড বিভাজন জানতেন। সেই নিরিখেই বিচার-বিবেচনায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি সম্ভবত। অন্যদিকে সংগীত জগতের ক্ষেত্রেও যে খুব বেশি বাইরের মানুষকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকতেন তিনি, সেটাও নয়।

এই ভাবনা বা পদক্ষেপের যুক্তি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় মোটেই। তাঁর ঘরে যিনি আছেন, তিনি যে সর্বার্থে অমূল্য। তাঁকে বাইরের দূষণ থেকে মুক্ত রেখেছিলেন বলেই তো বাংলা সংগীত জগৎ এমন এক শিল্পীর গানের পরশ, প্রাণের পরশ পেল, যা অনন্য, অতুলনীয় এবং অবিস্মরণীয়। শতাব্দীতেও এমন আর একজনকে যে পাবে না বাঙালি–তাঁর ‘এমন’ হয়ে ওঠার পিছনে শ্যামলবাবুর অবদান অস্বীকার করা যায় না। শ্যামল গুপ্তের যাবতীয় চাওয়ার কাছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের নিজেকে নিবেদন, নিভৃতচারণ, সংগীতকে নিজের ঈশ্বররূপে পূজা করা–এসবই ওঁদের দু’জনের ভালোবাসার সমান্তরাল ঘটনা। বড় সুন্দর ও মরমি এই একান্তের যৌথযাত্রা।

ওঁরা দুজনেই আজ এমন এক জগতে যা যাবতীয় তিক্ত বিশ্লেষণের বাইরে। যেটা সেদিন আমায় ক্ষুব্ধ করে, আজ নিজের মধ্যেই অন্য এক রূপে সেই ঘটনাকে অবলোকন করতে পারি। প্রাণপ্রিয় মানুষটিকে তাঁর অন্তরমহলের বাইরের সমস্ত প্রতিকূলতার হাত থেকে দূরে রাখার চেষ্টা শ্যামলবাবুকে হয়তো কিছুটা অপ্রিয় করেছিল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রাণের জগৎ ও গানের জগৎ–দু’টোকেই শান্তিপূর্ণ ও সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে অধিকারবোধের শিকারও হয়তো হন তিনি। কিন্তু সব কিছুর উৎসই তো ভালোবাসা। সেই ভালবাসা থেকেই তো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতো একজন শিল্পীও বিনা অভিযোগে মেনে নেন স্বামীর কর্তৃত্ব। স্বামী তো শুধু তাঁর প্রেমিক নন, সন্ধ্যার সুরপথের যাত্রীও তো বটে !

নিবিড় প্রেমই একদা ওঁদের তৎকালীন সামাজিক কঠিনতার বেড়া ভেঙে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করেছিল। ব্রাহ্মণকন্যা সন্ধ্যা নিজের পরিবারকে বোঝাতে সফল হয়েছিলেন, শ্যামল ভিন্নজাতের হলেও একজন উন্নতমনা, অত্যন্ত প্রতিভাবান ও গুণী, শিক্ষিত ও সর্বোপরি তাঁর প্রাণের মানুষ। দু’জনের সংগীত আর জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিল সেদিন। তাঁদের একান্তের প্রেম অনির্বচনীয় এক সৃষ্টির আকাশ হয়ে উঠলো। জাতপাত-অর্থনৈতিক বিভেদের উর্দ্ধে উঠে এমন এক একত্র সফরের গতিপথ রচনা করলেন এই দুই সৃজনশীল মানুষ–যা বাংলা সংগীতের ইতিহাসে লিখে ফেললো এক নতুন ও চিরন্তনী অধ্যায়।

এবার সেই প্রসঙ্গে যাব। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শ্যামল গুপ্তের পরিচয় করান বাংলা সংগীতের দিকপাল শিল্পী ও সুরকার সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। সন্ধ্যার জন্য শ্যামল প্রথম যে গান লিখলেন, সেটি হলো ‘স্বপ্নভরা অন্ধকারে/মোর গানেরই বীণাতারে…’। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত এই গানের সুর সৃষ্টি করেন সতীনাথ। এই গান তৈরিকে কেন্দ্র করেই ওঁদের পরিচয়। তারপরের অধ্যায় তো ইতিহাস। ‘শেষ অঙ্ক’ ছবির একটি অসাধারণ গান ‘আঁখি জাগে শ্যাম রূপ রাগে’ ও ‘মায়ামৃগ’ ছবির অলটাইম হিট ‘ও বক বকম বকম পায়রা’-ও শ্যামল গুপ্তের লেখা। এরপর এক অনন্যসাধারণ দ্বৈত-সৃজনের উদ্যোগ নিল তৎকালীন এইচএমভি, আজকের সারেগামা। ওদের পক্ষ থেকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে বলা হলো, নতুন গান তৈরি হবে ওঁর জন্য, যা লিখবেন শ্যামল গুপ্ত আর সুর সৃষ্টি করবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। সন্ধ্যা তো প্রথমে প্রবল আপত্তি জানান। তারপর সবার পীড়াপীড়িতে রাজি হলেন এবং তৈরি হলো চারটি কালজয়ী গান।

অসাধারণ সেই চারটি গান হলো ‘ঝরা পাতা ঝড়কে ডাকে’,’চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কি হবে’, ‘খোলা আকাশ কি অত ভালো লাগতো’ এবং ‘আমি তার ছলনায় ভুলবো না’। শেষের গানটি প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য সংযোজন–এটিতে আফগানিস্তানের লোকসংগীতের সুরের প্রভাব স্পষ্ট। সেই সময় দেশবিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আফগানিস্তানের এমনই এক অনুষ্ঠানে গিয়ে যোগাযোগ হলো ওস্তাদ মহম্মদ হুসেন সারহাংয়ের সঙ্গে। পাতিয়ালা ঘরানার এই ওস্তাদের কাছে সন্ধ্যা শিখলেন পুস্তু ও ফারসি ভাষার কয়েকটি গান। তারই একটি সুর পরে তিনি ব্যবহার করলেন শেষের গানটিতে। কী অনন্য প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বাংলা সংগীতের জগতে, তার অনেক প্রমাণের মধ্যে এটা অন্যতম। পাঠক লক্ষ্য করুন, চারটি গানেই কিন্তু প্রেমের নানা রং উদ্ভাসিত–যা দু’টি সৃজনশীল মানুষের অন্তরকথা হিসেবে ধরে নিতে আমাদেরও মন অমল এক অনুভবে পূর্ণ হয়ে ওঠে।

শ্যামলের লেখা আরও যে গানগুলি স্মরণীয় হয়ে থাকলো, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘কি করি সজনী আসে না প্রীতম’,’কাগজের এই নৌকো আমার’। এরই সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, আর একটি অতুলনীয় সৃষ্টি ‘আমার ভস্ম ছড়িয়ে দিও না বিন্ধ্য বা হিমাচলে’। এই গানটির সুর তৈরি করার কথা ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। তিনি সেসময় নানা কারণে ব্যস্ত থাকায় কাজটা থেমে ছিল। এদিকে শ্যামলের লেখা তৈরি। ঘটনাচক্রে এই সময়েই সন্ধ্যা আসামের গুয়াহাটিতে একটি অনুষ্ঠানে গেলেন। দেখা হলো ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে। ভূপেন গানটি পড়ে সঙ্গে সঙ্গে সুর তৈরি করে ফেললেন। এই গানটি আক্ষরিক অর্থেই একটি দার্শনিক ভাবনার গান, গীতিকারের গভীর ভাবনা অভিব্যক্ত সেখানে। তেমনই সুর এবং শিল্পীর নিবেদন।

রাধাকান্ত নন্দী আমৃত্যু তবলা সঙ্গত করেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। অনুষ্ঠান হোক বা রেকর্ডিং–ওঁরা সহযাত্রী। একবারের ঘটনা–সুরশ্রী অর্কেস্ট্রায় একত্রিত হয়েছেন শ্যামল গুপ্ত, সুরকার রবীন মজুমদার ও রাধাকান্ত নন্দী। চলছে ‘অভিসারিকা’ ছবির গান নির্মাণ। রাধাকান্ত তবলা বাজিয়ে চলেছেন নিজের মতো। বাকি দু’জন অনেক ভেবেও কিছুতেই এগোতে পারছেন না। গান আর আসে না। হঠাৎ তিনজনেরই খেয়াল হয়, অনেক বেলা হয়েছে, কিন্তু লাঞ্চ করা হয়নি। তিনজন একসঙ্গে খেতে বের হলেন। ফিরে এসে তৈরি হয়ে গেল গান–’কাঞ্চন কাঞ্চন পাহাড়ে…’।

একটা জিনিস লক্ষ্য করলে দেখা যাবে গানের কাব্যমূল্য বুঝে, তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠায় সন্ধ্যার জুড়ি ছিল না। এত রকমের ভাবনা, বিষয়, প্রেক্ষিতের ওপর নির্ভর করে রচিত হয়েছিল গানগুলি–যা বিস্ময়কর। আদতে তাঁকে ভেবেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গীতিকার-সুরকারদের সৃষ্টির তরণী এগিয়ে চলতো। আবার গান সৃষ্টির পরও তাঁরা ভেবেছেন, এ গান সন্ধ্যা ছাড়া আর কেউ গাইতে পারবেন না। এই যে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে ঘিরে অজস্র কালজয়ী গান সমৃদ্ধ করেছে বাংলাগানের ইতিহাসকে, তাঁর প্রধান কারণ নিশ্চয়ই শিল্পীর দুর্নিবার প্রতিভা ও দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সাধনা। কিন্তু এরই পাশাপাশি বলতে হয় সেই মানুষটির কথাও–নিশ্চিন্তে, জগৎ-সংসার ভুলে যাতে শুধু গানে ডুবে থাকতে পারেন সন্ধ্যা, সেই পরিসর শ্যামলই করে দেন তাঁকে।

গানের তথ্যসূত্র : সারেগামা বেঙ্গলি

ছবিঃ সংগৃহীত