Monday, February 3, 2025
বিনোদন প্লাস স্পেশাললাইম-Light

তারাদের মাঝে ভালো থাকুন সুশান্ত

পড়ুন অজন্তা সিনহার কলমে

মা বেঁচে থাকলে, আজ নিশ্চয়ই চোখের জলে ভাসতেন, অসময়ে চলে যাওয়া ছেলের জন্মদিনে। বাবা একাই আলোড়িত হচ্ছেন হয়তো দীর্ঘশ্বাসে–নাকি ভাইয়ের চার দিদিও আছেন তাঁর যন্ত্রনাসঙ্গী হয়ে ! আজ ২১ জানুয়ারি। আর একটি জন্মদিন। সময় এখনও তো পলি ফেলেনি বলিউডের সাম্প্রতিককালের অন্যতম সেরা তরুণ প্রতিভাবান অভিনেতাটির অকালে চলে যাওয়ার ইতিবৃত্তে। শোরগোল থেমে গেছে। আত্মহত্যা না খুন–তাই নিয়ে ঘোলাজলের রাজনীতি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু একান্তের বন্ধুরা ? পরিবার ? তাঁরা নিশ্চয়ই মনে মনে, স্মৃতির ঘরের এ কোন ও কোন জুড়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন সুশান্তকে ঘিরে জমাট বাঁধা কথাদের। আর অঙ্কিতা ? তাঁর মানবকে কী তিনি ভুলতে পেরেছেন ? ভোলা সম্ভব ?

Images 10 1

একতা কাপুরের ‘পবিত্র রিস্তা’ তখন টেলিভিশন দর্শকের মুখে মুখে। মানব আর অর্চনার সম্পর্কের টানাপোড়েনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তামাম হিন্দি টেলি দর্শক। এই মেগার হাত ধরেই জন্ম নেয় ছোটপর্দার সেরা হিট জুটি সুশান্ত সিং রাজপুত ও অঙ্কিতা লোখান্ডে। মেগার সেট ভিজিট ও সেখানেই সাংবাদিক সম্মেলন উপলক্ষে কলকাতা ও অন্যান্য রাজ্যের সাংবাদিকরা হাজির। সাংবাদিক সম্মেলনের প্রথামাফিক কাজকর্ম হয়ে যাওয়ার পর আমরা মুখোমুখি হলাম সুশান্ত, অঙ্কিতা ও ঊষা নাদকার্নির। ঊষা মারাঠি মঞ্চ, সিনেমা ও টেলিভিশনের প্রথমসারির অভিনেত্রী। মেগায় তিনি মানবের (সুশান্ত) মা এবং মানব-অর্চনার (অঙ্কিতা) সুসম্পর্ক-পথে প্রধান বাধা।

Images 16 1

অঙ্কিতা অসুস্থ ছিলেন সেদিন–জ্বরে ভুগছিলেন। মনে পড়ছে সুশান্ত অঙ্কিতাকে একেবারে আঁকড়ে ধরে বসেছিলেন। স্বভাবগত ভাবে সুশান্তকে খুব লাজুক ও অন্তর্মুখী মনে হয়েছিল। আর অঙ্কিতা ঠিক বিপরীত। ভীষণ মজার মানুষ ঊষা। সুশান্ত-অঙ্কিতার একে অপরকে জড়িয়ে থাকাকে দেখিয়ে ঊষা মারাঠি ভাষায় কিছু একটা মন্তব্য করেছিলেন, আজও মনে আছে। মুম্বইয়ের সাংবাদিকরা ছাড়া কেউই তার অর্থ বুঝিনি। সম্ভবত, দুই প্রেমিকের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতাকে উপলক্ষ করেই কিছু বলেন তিনি। নিছক মজাই ছিল তাঁর কথার সুরে। ছোটদের কান্ড দেখে বাড়ির বড়রা যেমন বলেন ! সেই সূত্র ধরেই বলবো, কোনওদিন সুশান্ত-অঙ্কিতা বিচ্ছিন্ন হবেন, এমনটা ভাবতেই পারিনি সেদিন ! কিন্তু বিচ্ছিন্ন হলেন ওঁরা। প্রায় একযুগ স্থায়ী সম্পর্কও ভাঙলো। দুজনের পথ দুদিকে বেঁকে গেল। এরইসঙ্গে  বিপুলভাবে বদলালো সুশান্তের জীবনযাপন।

২০১৩-র ‘কাই পো চে’ থেকে মৃত্যুর পর ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দিল বেচারা’– নানা ধরনের চরিত্রে নিজের স্বচ্ছন্দ বিচরণের মধ্য দিয়ে সুশান্ত প্রমান রাখেন তাঁর প্রতিভা, মেধা ও দক্ষতার। লেখাপড়ায় বরাবরের ভালো ছাত্র। অভিনয় করবেন বলেই দিল্লি কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া সমাপ্ত না করেই ছেড়ে দেন। তারপর যোগদান থিয়েটারে। একটা জিনিস তাঁর চরিত্রে শুরু থেকেই পরিস্কার–যুক্তির থেকে আবেগকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন তিনি। ঝুঁকি নিতে ভালোবাসতেন। সম্পর্কে নিমজ্জিত থাকতে চাইতেন। আবার সেই  সম্পর্কজনিত অস্থিরতাই তাড়া করতো তাঁকে। একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া তো সেই অস্থিরতা থেকেই ! এতে যে উজ্জ্বল সম্ভাবনার পথে চলছিল তাঁর কেরিয়ার, সেখানেই অবশ্যম্ভাবী ধাক্কা লাগছিল বারবার।

Images 14

যে সুশান্তকে সাংবাদিক সম্মেলনে দেখি আর পরে বলিউড চর্চায় যাঁর খবরাখবর পাই–দু’জনের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। সেটাই হয়তো বাস্তব। জীবনের ছোট পরিধি থেকে বড় ক্ষেত্রে পা রাখলে পরিবর্তন হবেই। কিন্তু সুশান্তের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের পথটা উত্তরণ অভিমুখী না হয়ে কোথাও কী দিশা হারিয়েছিল ? এরই পাশাপাশি মায়ের আকস্মিক মৃত্যু, অঙ্কিতার সঙ্গে ব্রেকআপ–এগুলোও কী পতনের ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছিল ? নিরাপত্তাবোধের অভাবেই কী বাইরের অন্ধকারে আলো খুঁজে নেওয়ার প্রবণতা ঘটছিল ? কোনও বিভ্রান্তি ? চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে অসামঞ্জস্য ? প্রশ্নগুলো থেকে গেছে নিরুত্তর হয়ে। আকাশের তারাদের খোঁজার পথ ধরে, তিনি নিজেই আজ অনেক দূরের এক তারা !

একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক এ প্রসঙ্গে উল্লেখ প্রয়োজন। বিনোদন দুনিয়ায় আয়-ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষার একটা পৃথক ব্যাকরণ আছে, যেটা এর বাইরের জগৎটা থেকে অনেকটাই আলাদা। যেমন কঠিন, তেমনই নিষ্ঠুর এক বাতাবরণ ঘিরে ধরে  আর্থিক সক্ষমতা পর্যাপ্ত না থাকলে। এই সক্ষমতার রূপরেখা তৈরি ও বজায় রাখা মধ্যবিত্ত আবেগে সম্ভব নয়। প্রতি মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। ভালো বন্ধু ও সঠিক পরামর্শদাতা অত্যন্ত জরুরি। সুশান্তের ক্ষেত্রে এই অভাবগুলো ঘটেছিল নিঃসন্দেহে। স্বপ্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সঙ্গে যখন নেপোটিজম, লবিবাজি মিশে যায়, তখন লড়াইটা কত কঠিন হয়ে পড়ে, যে জানে, সে জানে। এ ব্যাপারে শত্রুতা করতে কেউ কম যায় না। কিন্তু শুধু কী এই কারণেই, এই অসময়ে চলে যাওয়া ?

Images 13

আকাশের দিকে মাঝে মাঝেই চোখ রাখতো যে তরুণ, তাঁর জন্য কোথাও বোধহয় এক ঠিকানাহীন হয়ে যাওয়ার কাহিনী লেখা হচ্ছিল অজান্তেই। চরাচর জুড়ে একটা বিষন্ন বলয় তৈরি হচ্ছিল। মন খারাপের ভিজে বাতাস উড়িয়ে দিচ্ছিল স্মৃতিদের। সম্পর্কগুলো কিছুতেই আশ্রয় দিতে পারছিল না। ২০২০-র ১৪ জুন মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তাঁর বান্দ্রার ফ্ল্যাটে আত্মহত্যা করেন সুশান্ত। এই নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হয়। খুন না আত্মহত্যা–বেশ কিছুদিন বাজার গরম থাকে এই খবরে। উঠে আসে ড্রাগচক্র বিত্তান্ত। তাঁর টাকা নয়ছয় করা হচ্ছিল, এমন অভিযোগও শোনা যায়। বেশ কিছু নাম সুশান্তকে ঘিরে পুলিশের তদারকিতে উঠে আসে, যার শীর্ষে ছিলেন রিয়া চক্রবর্তী। তাঁর গ্রেফতার ও জামিন ইত্যাদির পর আপাতত সব ধামাচাপা। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন সুশান্ত–এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছে সিবিআই।

Images 15 2

এম এস ধোনি, ব্যোমকেশ বক্সীর চরিত্র থেকে শুদ্ধ দেশি রোমান্স, কেদারনাথ, ছিছোড়ে, পিকে ইত্যাদি ছবিতে সুশান্ত একদিকে যেমন নিজের অভিনয় দক্ষতার প্রমান দিচ্ছিলেন। অন্যদিকে শিক্ষিত, চূড়ান্ত স্মার্ট, ডান্স সেনসেশান সুশান্ত আলো করে রাখতেন বলিউডের এওয়ার্ড শোয়ের মঞ্চগুলি। সাফল্য দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছিল তাঁর। তারকা হওয়ার সব ক’টি গুণ সুশান্তের মধ্যে ছিল। তাই কী ঈর্ষার বিষের উদ্গীরণ ? কিন্তু না। এই থিওরিও টিকছে না। তাঁর এই পরিণতি নিছক লবিবাজির শিকার হওয়ার জন্য–এমনটা জোর দিয়ে কেউই আর এখন বলতে পারছেন না। এমন অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটেছে । তাঁরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেননি। আর বড় ব্যানারে একেবারেই কাজ পাননি সুশান্ত এমনও নয়।

Images 11 1

তাহলে কী ? আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া কী তাৎক্ষণিক এক সিদ্ধান্ত ? মনস্তাত্বিকরা আত্মহত্যার কারণ হিসেবে এই সম্ভাবনার কথা বলেন। এ এক মানসিক রোগ। অনেকে বারবার আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে ব্যর্থ হন–এমন ঘটনাও শোনা যায়। সুশান্তের ক্ষেত্রেও এটা ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি তাঁরা। প্রেক্ষিত অনুকূল বা প্রতিকূল হওয়া মানুষের জীবনের একটি দিক নিশ্চয়ই। কিন্তু হাজার প্রতিকূলতার মাঝেও নিজেদের টিকিয়ে রেখে বেঁচে থাকেন বহু মানুষ। সুশান্তের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার বিষয়গুলি বড়ই আলগা সুতোয় বাঁধা। তার থেকে আশপাশের লোকজন যে গল্প বুননের চেষ্টা করেন, তা ধোপে টেকেনি। তাঁর মানসিক অবসাদ বা অসহায়ত্ব সম্ভবত সুশান্তের নিজেরই তৈরি বেড়াজাল, যা ছিঁড়ে বের হওয়ার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। ভারতীয় সিনেমা হারিয়েছে আগামী দিনের এক বড়মাপের অভিনেতাকে।