Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

মুক্তচিন্তার প্রতীক ডিরোজিও আজও প্রাসঙ্গিক

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেনও চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। আগামী ১৮ এপ্রিল হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর জন্মদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই প্রতিবেদন লিখেছেন মন্দিরা পান্ডা।

ভারতবর্ষের হাজার বছরের ভ্রান্ত সংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাসের বাতাবরণ সরিয়ে মুক্ত আলোর পথে যাত্রার পথিকৃৎ যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অন্যতম রাজা রামমোহন রায়। সমসাময়িক কালে তিলোত্তমার বুকে তাঁরই পাশাপাশি ঝড় তুলেছিলেন একদল খ্যাপাটে বুদ্ধি ও যুক্তিবাদী ছাত্র। যাঁরা অশান্ত, অপ্রতিরোধ্য, অথচ চূড়ান্ত মাত্রায় স্পষ্ট। তাঁরা আধুনিক ভারতের প্রথম প্রথাবিরোধী ও মুক্তচিন্তার সংঘবদ্ধ সংগঠন ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটি এবং তাঁদের কাণ্ডারী হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। ডিরোজিওর পূর্বপুরুষরা ভারতবর্ষে আসেন সুদূর পর্তুগাল থেকে। এরপর আর ফিরে যাননি। সেইসময় থেকেই ভারতে বসবাসরত ইউরোপীয় অথবা এশিয়া-ইউরোপ মিশ্রিত জনগোষ্ঠী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বা ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত হয়।

১৮০৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল কলকাতার এন্টালি-পদ্মপুকুর অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন ডিরোজিও। তাঁর বাবা ছিলেন ফ্রান্সিস ডিরোজিও, একজন খ্রিস্টান ইন্দো-পর্তুগিজ অফিসকর্মী এবং তাঁর মা ছিলেন সোফিয়া জনসন ডিরোজিও, একজন ইংরেজ মহিলা। চোদ্দ বছর বয়সে লেখাপড়ায় ইতি টেনে কিছুদিন তাঁর বাবার কর্মস্থলে চাকরি করেন ডিরোজিও। তারপর শুরু করেন কাব্যচর্চা। ইমানুয়েল কান্টের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের সমালোচনা ও বেশ কিছু সাড়া জাগানো কবিতা লিখে তরুণ বয়সেই খ্যাতি অর্জন করেন। এই খ্যাতির ফলে কলকাতার বিখ্যাত হিন্দু কলেজ তাকে ডেকে এনে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে সাড়াও দেন ডিরোজিও।

১৮২৮ সালের মার্চ মাসে ডিরোজিও হিন্দু কলেজের চতুর্থ শ্রেণীর সাহিত্য ও ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতার শুরুতেই তিনি সহ-শিক্ষকদের সঙ্গে নিজের পার্থক্য প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যা সম্ভবত তাঁর স্বকীয় পাঠদান পদ্ধতি ও ছাত্রদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে। ফলত, শুধুমাত্র নিজের নির্দিষ্ট শ্রেণির ছাত্র নয়, সব শ্রেণির ছাত্রদের কাছে তিনি প্রিয় ছিলেন। তথাকথিত ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বিধিনিষেধের বাইরে, শিক্ষকদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বা কোথাও বসে লেখাপড়ার বাইরেও যে কথা বলা যায়, তা ডিরোজিওর ক্ষেত্রে খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঘটতে থাকে। বলা বাহুল্য, বিষয়টা তরুণ সমাজের কাছে এক দুর্নিবার আকর্ষণে পরিণত হয়। ছাত্ররা তাঁর কাছে এলে তিনি আড্ডার ছলে নিজ চিন্তা ও দর্শন তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতেন। ছাত্ররাও অভয় পেয়ে শিক্ষককে প্রশ্ন করতো। এমনকী দ্বিমতও প্রকাশ করতো ! ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদেরকে দ্বিমত ও প্রশ্নে উদ্বুদ্ধ করতেন।

তিনি ছাত্রদের মাঝে খুঁজে দেখার চেষ্টা করতেন, তাদের মধ্যে কারা মেধাবী ও প্রতিভাবান। তাদের মেধা ও প্রতিভার প্রতি যত্ন নেওয়ার জন্য সেবছরই প্রতিষ্ঠা করলেন ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠন ছিলো বাংলায় মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রথম মঞ্চ। অনেকেই অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনকে বঙ্গে প্রগতিশীল সভা সংগঠনের শিকড় হিসেবে বিবেচনা করেন। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, মাধবচন্দ্র মল্লিক, রামতনু লাহিড়ী, প্যারীচাঁদ মিত্র, মহেশচন্দ্র ঘোষ, শিবচন্দ্র দেব, হরচন্দ্র ঘোষ, রাধানাথ শিকদার, গোবিন্দচন্দ্র বসাক, অমৃতলাল মিত্র সহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়মিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের সভায় অংশ নিতেন। সভাপতিত্ব করতেন ডিরোজিও।

বিদেশি সাহিত্যপাঠ ও আলোচনার মধ্য দিয়ে সভার কার্যক্রম শুরু হলেও, কিছুদিন পর স্বরচিত প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনা শুরু হয়। যার বিষয়বস্তু ছিল মূলত হিন্দু ধর্মের সমালোচনা ও সমাজ সংস্কার বিষয়ক। এহেন কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা বহু শ্রোতাদের আকৃষ্ট করেছিল। প্রতিদিন শ্রোতার আসনে সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে। তরুণদের পাশাপাশি প্রবীণরাও সেখানে অংশ নিতে শুরু করেন। শ্রোতার আসনে স্থানীয় ভারতীয়দের পাশাপাশি বেশকিছু ইংরেজ ও অন্যান্য বিদেশি মুখ পরিলক্ষিত হতো। যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রসারক ডেভিড হেয়ার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এডওয়ার্ড রায়ান, ডেপুটি গভর্নর মিস্টার বার্ড, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিকের ব্যক্তিগত সচিব কর্নেল বেনসন, বিশপ কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর মিলস প্রমুখ। একদিকে প্রগতিশীল চিন্তার মানুষরা বাঙালি ছেলেদের মনে গভীর চিন্তাবোধের দেখা পেয়ে অত্যন্ত খুশি ও তৃপ্ত। অন্যদিকে আবার পূর্বপুরুষদের ধর্ম ও সমাজের সমালোচনা দেখে পুরাতনবাদীরা বিশেষভাবে শঙ্কিত হচ্ছিলেন। শহরজুড়ে মৃদুমন্দ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলো। তৈরি হলো ইয়ং বেঙ্গলের পক্ষ ও বিপক্ষ।

ইয়ং বেঙ্গলের প্রথম পত্রিকার নাম ‘Ethenium’। এই মাসিক পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ডক্টর উইলসন। এই পত্রিকার মূল কাজ ছিলো হিন্দু ধর্মকে আক্রমণ করে লেখালেখি প্রকাশ করা। প্রথম সংখ্যায় মাধবচন্দ্র মল্লিক নামে এক ছাত্র হিন্দু ধর্ম নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বলেন, If there is anything that we hate from the bottom of our heart, it is Hinduism. এই প্রবন্ধ প্রকাশের পর শিক্ষিত হিন্দু সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। এক বিদেশীর প্ররোচনায় স্বদেশী ধর্মকে আক্রমণ করছে কিছু বাঙালি ছোকরা, এটা মেনে নিতে পারেননি তাঁরা।

দেখা গেল, নালিশে কোনও কাজ হয় না। এমনকী এই ছেলেদেরকে মা বাবা জোর করে পূজার ঘরে নিয়ে গেলে, সেখানে বসে মন্ত্র না পড়ে হোমারের সাহিত্য পড়তো তারা। ঘরের বাইরে এসে আগের চেয়ে দ্বিগুণ উচ্চারণে সংস্কারের আওয়াজ তোলে। সংস্কারের ক্ষেত্রে ইয়ং বেঙ্গল যেসব খাতে গুরুত্ব দিয়েছে, সময় বিচারে তা ছিল এককথায় অভিনব ও অসাধারণ। ভয়ডরহীন স্বচ্ছ, চঞ্চল ও তারুণ্যের দীপ্তিতে পূর্ণ। যুক্তি ও সত্য উপস্থাপনে আগে পিছে কিছু চিন্তা করতো না তারা। সত্য প্রকাশে কার ক্ষতি হবে, কার অনুভূতি আক্রান্ত হবে, কার রাজনৈতিক অসুবিধা হবে–এই জাতীয় ভাবনার তোয়াক্কা ছিল না তাদের। 

ডিরোজিও তাঁর অনুসারীদের শিখিয়েছিলেন কী করে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তুলতে হয়, বিকশিত করতে হয়। শিখিয়েছেন কী করে মানুষকে সমাজ-সংগঠনের বন্ধনে আবদ্ধ করতে হয়। ছাত্রদেরকে জ্ঞানানুরাগী হতে এবং যে কোনও অন্ধবিশ্বাস পরিত্যাগ করতে দীক্ষা দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার পুঁজি ছিল ইতিহাস আর দর্শন। ডিরোজিও একটা উপদেশই সবসময় দিতেন, ‘সত্যের জন্য বাঁচো, সত্যের জন্য মরো’। শিক্ষকের যুক্তির আলোয় আলোকিত হয়ে ভ্রান্ত বিশ্বাস ও মিথ্যা ভক্তির উচ্ছেদে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করে তাঁর শিষ্যরা। মানুষের কাছে জ্ঞানের দুয়ার খুলে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা ১৮২৮ থেকে ১৮৪৩ সালের মধ্যে বেশ কিছু পত্রিকা প্রকাশ করেন। Ethenium, Parthenon, Hesperus, জ্ঞানান্বেষণ, Enquirer, Hindu Pioneer, Quill এবং The Bengal Spectator যার মধ্যে অন্যতম। এর মধ্যে জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকাটি দীর্ঘদিন চলেছিল। ১৮৩১ থেকে ১৮৪৪ সাল পর্যন্ত এটি প্রকাশিত হয়। দ্বিবার্ষিক এই পত্রিকার সংগঠক ছিলেন রসিককৃষ্ণ মল্লিক। এর উদ্দেশ্যে ছিল শাসনপ্রক্রিয়া ও ব্যবহারশাস্ত্রে মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা।

Images 8

১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল ইয়ং বেঙ্গলের ধারাবাহিক দাবির ফসল। মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর শবব্যবচ্ছেদ বিষয়ে প্রচলিত সংস্কার ভেঙে ফেলার জন্য ছাত্রদের উৎসাহিত করে ইয়ং বেঙ্গল। ১৮৩৮ সালে তাদের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করে আরও একটি সংগঠন–‘সোসাইটি ফর দি অ্যাকুইজিশন অব জেনারেল নলেজ’। তারাচাঁদ চক্রবর্তী ছিলেন এ সোসাইটির সভাপতি এবং প্যারীচাঁদ মিত্র ও রামতনু লাহিড়ী ছিলেন সম্পাদক। মূলত পত্র মাধ্যমে একের সাথে অপরের চিন্তাভাবনা ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য এই সংগঠনের জন্ম। ইয়ং বেঙ্গল কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে সাড়া জাগানো ছিল ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’। ১৮৪২ সাল থেকে প্রকাশিত এ মাসিক পত্রিকাটি সমসাময়িক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাবলি নিয়ে লেখা প্রকাশ করে।

তবে এই পত্রিকাটি তিনটি কারণে বাংলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে। প্রথম কারণ, বিধবা বিবাহ। বাংলায় বিধবা বিবাহ নিয়ে সর্বপ্রথম আলোচনা বা তর্কের ধারাবাহিক আয়োজন করে বেঙ্গল স্পেক্টেটর। ফলে, এ বিষয়ে সমাজে আলোচনা শুরু হয়। পরবর্তীতে বিধবা বিবাহ নিয়ে ভ্রান্ত ধ্যান ধারণা বিলোপের সুযোগ ঘটে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখলেও শুরুটা হয় ইয়ং বেঙ্গলের হাত ধরে।

দ্বিতীয় কারণ, নারী শিক্ষা। উচ্চশিক্ষায় জাত বৈষম্য নিয়ে ইয়ং বেঙ্গল একাধিক কাজ করেছে। একসময় তারা নারীশিক্ষার পক্ষেও কথা বলতে শুরু করে। বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকায় এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক-আলোচনার আয়োজন করা হয়। ১৮৩৪ সালের হিসাব অনুযায়ী কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদসহ কয়েক জায়গায় মোট ১৯টি বালিকা বিদ্যালয়ে ৪৫০ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করতো। কিন্তু তাদের সবাই ছিল খ্রিস্টান। স্কুলগুলিও খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই স্থাপিত হয়। মূল জনগোষ্ঠীর সাথে এর কোন সম্পর্ক ছিল না। বালিকাদের জন্য প্রথম অসাম্প্রদায়িক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন জন এলিয়ট বিটন নামের বাঙালি হিতৈষী ব্রিটিশ রাজকর্মচারী। যিনি বঙ্গদেশে বেথুন সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন। বেথুন সাহেব স্কুল প্রতিষ্ঠার পর সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কট্টর হিন্দু নেতা হিসেবে পরিচিত রাধাকান্ত দেব, ব্রাহ্ম সমাজের দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ইয়ং বেঙ্গলের রামগোপাল ঘোষ–সবাই নারীশিক্ষার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হন। সূচনা করেন নিজের পরিবারের স্ত্রী ও কন্যাদের স্কুলে পাঠানোর মাধ্যমে।

তৃতীয় যে কারণে বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকাটি ঐতিহাসিক, তা হলো সাহিত্য। বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর খসড়া এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির রচয়িতা প্যারীচাঁদ মিত্র, যিনি বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকার একজন সম্পাদক ছিলেন। অপর সম্পাদক ছিলেন রাধানাথ শিকদার। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিকিৎসা সহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ইয়ং বেঙ্গল অবদান রেখেছে। সামাজিক পরিবর্তন যেন মজবুত হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতেন তাঁরা। কলকাতাবাসীকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চায় সম্পৃক্ত করতে শহরের বিভিন্ন জায়গায় গণপাঠাগার নির্মাণে অবদান রাখে তারা। এই কাজ করতে গিয়েও অপবাদ গায়ে মাখতে হয়। পাঠাগারে বিদেশী বই রাখার কারণে প্রগতিশীল শ্রেণির অনেকে তাদের সমালোচনা করে।

সমাজে এই আলোড়ন সৃষ্টির মাশুল ডিরোজিও দিয়েছিলেন নিজের কর্মজীবন দিয়ে। প্রথমে কলেজের প্রধান শিক্ষককের উপর চাপ দেওয়া হয়, অন্য শিক্ষকরা যেন শ্রেণিকক্ষে অথবা কক্ষের বাইরে ছাত্রদের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে কথা না বলে। সমাজের প্রভাবশালীদের কথামতো হেডমাস্টার তাই করলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ধর্ম নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা চলছেই। তাই হিন্দু নেতারা এবার পরিকল্পনা মাফিক কলেজের গোঁড়া হিন্দু ছাত্রদের ব্যবহার ক’রে ডিরোজিওর নামে বিচারসভার আয়োজন করে। বিচারক ছিলেন প্রাচীনপন্থী হিন্দু নেতা রাধাকান্ত দেব। তিনি কলেজ পরিচালনা পর্ষদের প্রধানও ছিলেন। ডেভিড হেয়ার ও ডক্টর উইলসনসহ কয়েকজন শুভাকাঙ্খী ডিরোজিওর পক্ষে চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। কারণ বিচারের রায় আগেই ঠিক করা ছিল। রায়ে ডিরোজিওকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খবর পেয়ে পদচ্যুত হবার আগে তিনি নিজেই পদত্যাগ করেন। শিক্ষকতা ছাড়ার পর নিজে সম্পাদনা করতেন ‘দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া’ পত্রিকা। একযোগে চলেছিল গোঁড়া হিন্দুধর্মের ময়নাতদন্ত। কিন্তু খুব বেশিদিন ব্যস্ত থাকতে পারেননি তিনি। দূরারোগ্য কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৩১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ডিরোজিও মারা যান।

তাঁর মৃত্যু ছিলো প্রগতিশীলদের কাছে বিষাদের। আর গোঁড়াদের কাছে স্বস্তির। হিন্দু নেতারা ভাবলো, এবার বুঝি ইয়ং বেঙ্গল নিজেরা নিজেরা ঝগড়া করে কয়েকভাগে ভাগ হয়ে যাবে। অথবা ডিরোজিওর শোকে মূর্ছা গিয়ে শক্তি হারাবে। অন্ততপক্ষে একটা ঘোর ঝিমুনি তো আসতেই পারে। কিন্তু বাস্তবচিত্র অন্য কথা বলে। ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যদের দমিয়ে রাখতে তাদেরকে সমাজচ্যুত করার চেষ্টাসহ পারিবারিক ও সামাজিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। এসব বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ইয়ং বেঙ্গল এগিয়ে গিয়েছে। ১৯৩৮ সালে তারা প্রকাশ করে ‘হিন্দু পাইওনিয়ার’ নামে একটি পত্রিকা। এই পত্রিকায় প্রকাশিত ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর রচনাবলি থেকে বোঝা যায়, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বিদ্যমান ছিলো। তারাচাঁদ চক্রবর্তী প্রকাশিত কুইল পত্রিকাটিও সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিল।

ডিরোজিও এবং ইয়ং বেঙ্গলের দর্শন বোঝার চেষ্টা করলে দেখা যাবে, তারা হিন্দুধর্মকে আঘাত করেননি। প্রশ্ন তুলেছেন। কিছু অযৌক্তিকতা বিষয়ে জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছেন। যুক্তিহীন শাস্ত্রবচন, ক্ষতিকর লোক-বিশ্বাস আর ধর্মীয় গোঁড়ামি কি বঙ্গসংস্কৃতির অংশ? সংস্কৃতির অংশ হলেও তা বর্জন করা উচিত।

সেই প্রেক্ষিতেই বলা যায়, ডিরোজিওর এই সামাজিক আন্দোলন নিরঙ্কুশ সফল । তৎকালীন ‘গড়ি দেশ, ধরে ধর্মের বেশ’ সমাজে ইয়ং বেঙ্গলের কর্মকাণ্ড বিতর্কের সৃষ্টি করলেও কুসংস্কারাচ্ছিত ভঙ্গুর সমাজে তার প্রভাব ছিলো সুদূরপ্রসারী। বিশেষত বাংলা ভাষায় পত্রপত্রিকা সম্পাদনা, বিতর্কসভা, গ্রন্থ প্রকাশ প্রভৃতির মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন ডিরোজিও ও তাঁর ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটি। এমনকী ইতিহাস ও সংস্কৃতির নিদর্শন সংরক্ষণেও তারা ছিলো সবার আগে। ভারতে শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা গভর্নর জেনারেল হেনরি হার্ডিঞ্জ ও ডেভিড হেয়ারের ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ইয়ং বেঙ্গল। সমাজ উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যকর অবদান রেখেছে এমন আন্দোলন ইয়ং বেঙ্গল ব্যতীত দ্বিতীয় আর কারও নেই। গোঁড়া বাংলায় মুক্তচিন্তার অবারিত দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন তরুণ শিক্ষক ডিরোজিও। বর্তমান সমাজে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির যে ঢেউ জেগেছে, তার সূচনা হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই ফিরিঙ্গি ছোঁড়ার হাত ধরেই।