হারানো দিনের গানের গল্প…
চল্লিশ পেরিয়ে আসা বাঙালি এখনও স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ে পুরনো বাংলাগান শুনে। সেইসব গানের গল্পই এই বিশেষ ধারাবাহিক প্রতিবেদনে। আজ তৃতীয় পর্ব। লিখছেন প্রদীপ্ত চৌধুরী।
কথা সুরের অনুপম যুগলবন্দি আর গায়কীর গুণে কেমন করে এক একটি গান কালজয়ী হয়ে উঠেছিল, সেই গল্পই শোনাচ্ছি আপনাদের। শুধু কথার অনুসরণেই যে এমন সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে, তা নয়। অনেক সময় সুরের ওপর কথা বসিয়েও গান তৈরি করা হয়েছে। বহু বাংলা গানের ক্ষেত্রেই ঘটেছে এমনটা। ১৯৫৪ সালে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির পরিচালক বিভূতি লাহা (অগ্রদূত) শুটিংয়ের আগে সুরকার অনুপম ঘটককে একটি গানের দৃশ্য শুধু বর্ণনা করেছিলেন। দৃশ্যটা ছিল এইরকম, একটা পাহাড়ের সন্নিকটে উত্তম-সুচিত্রা বসে আছেন। চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে কুয়াশা। নায়িকা তাঁর প্রেমের ভাব প্রকাশ করছেন অদ্ভুত মিষ্টি সুরেলা এক গানের মাধ্যমে। সে গান তখনও লেখা হয়নি। সুরকার অনুপম ঘটক কিন্তু দৃশ্যটা কল্পনা করেই সুর ভেঁজে ফেললেন মনে মনে। পরে সেটা ধরলেন হারমোনিয়াম আর নোটেশনে। গৌরীপ্রসন্ন বেশ কিছুদিন পরে সেই সুরের ওপর কথা বসালেন। গাইলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’-র ফেড আউট করা সুর কিন্তু আজও স্বপ্ন ছড়িয়ে চলেছে অক্লান্তভাবে ।
তথাকথিত সামান্য কোনও বিষয়ও দমকা আবেগের জেরে অসামান্য গান হয়ে উঠেছে, এমন নজিরও নেহাত কম নয়। এ ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। একবার মান্না দে-র বাড়ি যাওয়ার পথে কোনও বাড়ির জানলার ফ্রেমে আটকে থাকা এক অপরূপ নারীমুখ দেখে নিমেষে লিখে ফেলেছিলেন ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো…’-র মতো মিষ্টি চটুল গান। আরেকবার কারও বাড়ির ছাদে টবে ফুটে থাকা একটি চন্দ্রমল্লিকা দেখে এক ঝটকায় লিখে ফেলেছিলেন ‘ও আমার চন্দ্রমল্লিকা, বুঝি চন্দ্র দেখেছে…’।
এহেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও কিন্তু বেশ কয়েকবার থমকে যেতে হয়েছে। একটা ঘটনার কথা বলা যাক। ছবির নাম ‘পিকনিক’। সুরকার সুধীন দাশগুপ্তর যতীন দাস রোডের বাড়িতে বসে তাঁর তৈরি সুরের ওপর কথা বসাচ্ছেন পুলকবাবু। গানের মুখরাটা তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু অন্তরায় পৌঁছে কিছুতেই আর যুতসই কথা খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। এদিকে সময় ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। রাত হয়ে গেছে অনেকটা। দক্ষিণ কলকাতা থেকে গাড়ি চালিয়ে ফিরতে হবে সেই হাওড়ায়। পুলকবাবু সুধীনবাবুকে বলতে বাধ্য হলেন, “আপনি অন্তরার সুর না বদলালে আমার আর কিছু করার নেই।” এদিকে সুরকারও নাছোড়। সুধীনবাবুর কথায়, ওই সুর বদলানো নাকি অসম্ভব।
এরপর সুধীনবাবুই পাশের ঘরে গিয়ে পুলকবাবুর বাড়ি ফোন করে জানিয়ে দিলেন, বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় তাঁকে আজ আর ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না। পুলকবাবুকে সে কথা জানাতেই তিনি নিশ্চিন্ত হলেন এবং নিমেষের মধ্যে লিখে ফেললেন সেই থেমে থাকা অন্তরা। ‘দিন এসে এসে / যায় ফিরে ফিরে / চোখ চেয়েই যে থাকে / মন সারাবেলা / সেই পথে পথে / কান পেতে রাখে / সব হারানোর পথে নেমে কি / পথ চাওয়া আর সাজে / মরি লাজে / বুকে বাজে’। দারুণ হিট করেছিল আশা ভোঁসলের গাওয়া সেই গান…’কেন সর্বনাশের নেশা ধরিয়ে তুমি এলে না যে’। (চলবে)