সব বাবারই হৃদয় জুড়ে থাকে যে ‘বুড়ি’
আজই মুক্তি পাচ্ছে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও দিতিপ্রিয়া রায় অভিনীত ‘আয় খুকু আয়’। এ ছবির বুড়িকে দেখলেই ভালোবেসে ফেলবেন আপনি। সেই বুড়ি অর্থাৎ দিতিপ্রিয়াকে নিয়ে লিখেছেন সোমনাথ লাহা।
যদি জিজ্ঞাসা করি, আপনারা চেনেন বুড়িকে ? চিনতে পারছেন না ? ওর ভালো নাম অবশ্য শতাব্দী। বুড়ি তো ওর ডাক নাম। এখনও চিনতে পারছেন না ? আচ্ছা আরেকটু খোলসা করে বলছি। বুড়ির বাবার নাম নির্মল মন্ডল। ট্রেনে হকারি করেন। শহুরে নাগরিক নন, প্রান্তিক মানুষ। টলিউডের সুপারস্টার প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের দারুণ ফ্যান। পাড়ার মঞ্চে প্রসেনজিতের মতো সেজে অনুষ্ঠান করেন। মাথায় টাক থাকায় লোকজন ‘টেকো প্রসেন’ বলে খেপায়। মেয়ে-অন্ত প্রাণ মানুষটা। মা-হারা মেয়েকে যত্ন করে লালন-পালন করছেন। চুল বেঁধে দেওয়া থেকে মেয়ের জন্মদিনে নিজের হাতে পায়েস বানানো–মেয়ের সব আবদার পূরণ করতে সদা তৎপর নির্মল।
তবে, বাবাকে শাসন করতে ছাড়ে না বুড়িও। বাবা-মেয়ের এই মনকাড়া কাহিনি শুনে কেমন একটা মন কেমন করা অনুভূতি হচ্ছে, তাই না ? সেলুলয়েডে এমন গল্পেরই বুনন ঘটিয়েছেন পরিচালক শৌভিক কুন্ডু তাঁর ছবি ‘আয় খকু আয়’-তে। জিৎজ ফিল্মওয়ার্কসের ব্যানারে নির্মিত এই ছবির নির্মল মন্ডলের চরিত্রে রয়েছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং বুড়ির ভূমিকায় দিতিপ্রিয়া রায়। ছবির ট্রেলার লঞ্চের দিন তা দেখে মন ছুঁয়ে গেছে উপস্থিত সব দর্শকেরই। তবে, এই ছবির ট্রেলার যাঁর চোখের কোণ ভিজিয়ে দিয়েছে, তিনি হলেন অলোকশঙ্কর রায়–পর্দার ‘বুড়ি’ অর্থাৎ দিতিপ্রিয়া রায়ের বাবা। স্টার থিয়েটারে ট্রেলার দেখে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত তিনি। তাঁর কথায়, “সিরিয়াল-বড়পর্দায় এর আগেও আমার মেয়ের কাজ দেখেছি। কিন্তু এই ছবির ট্রেলার দেখে আমার চোখে জল এসে গেছে। আমার মেয়ে এত ভালো অভিনয় করতে পারবে, কোনওদিন ভাবিনি, তাও আবার বুম্বাদার সঙ্গে একফ্রেমে।”
আবেগতাড়িত মানুষটি একথাও জানিয়েছেন, তিনিও ঠিক একইভাবে ছোটবেলায় দিতিপ্রিয়ার চুল বেঁধে দিতেন। এমনকি দিতিপ্রিয়া যে বাবা-মায়ের বাধ্য সেকথাও জানাতে ভোলেননি তিনি। তাঁর কথায়, “আমার মেয়ে কথা শোনে। কথা শোনে বলেই ঠিকঠাক জায়গায় এসে পৌঁছেছে।” একদা টলিপাড়ার অভিনেতা অলোকশঙ্কর শারীরিক অসুস্থতার কারণে অভিনয় জীবন থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। তাঁর মেয়ে দিতিপ্রিয়া সেই অভিনয় দুনিয়ায় নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে আজ যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে অলোকশঙ্করের স্বপ্নপূরণ হয়েছে, বলাই বাহুল্য।
শিশুশিল্পী হিসেবেই অভিনয়ের অঙ্গনে পা রাখেন দিতিপ্রিয়া। স্টার জলসার মেগা ধারাবাহিক ‘দুর্গা’-তে দুর্গার বালিকারূপ ‘গৌরী’-র চরিত্রে দর্শকের নজর কাড়েন শিশুশিল্পী দিতিপ্রিয়া। এমনকি জনপ্রিয় ‘মা’ ধারাবাহিকেও কাজ করেছেন শিশুশিল্পী হিসেবেই। জলসার আরেক মেগা ‘অপরাজিত’-তে যিশু সেনগুপ্তর কন্যার চরিত্রেও ছোট দিতিপ্রিয়ার অভিনয় মন ছুঁয়ে যায় সকলের। এরপর কালারস বাংলায় ‘ব্যোমকেশ’ সিরিজের ‘মগ্নমৈনাক’ কাহিনিতে ‘চিংড়ি’-র চরিত্রে দেখা যায় দিতিপ্রিয়াকে।
২০১৫-তে ছোটপর্দা থেকে বড়পর্দায় পা রাখেন দিতিপ্রিয়া, সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘রাজকাহিনী’ ছবির হাত ধরে। ছবিতে দিতিপ্রিয়া অভিনীত চরিত্রটির নাম ছিল ‘বুঁচকি’। এর ঠিক পরপরই জি বাংলা সিনেমা অরিজিন্যালস-এ ‘দেব আই লাভ ইউ’ ছবিতে দিতিপ্রিয়ার স্বতস্ফূর্ত অভিনয় রীতিমতো প্রশংসিত হয় দর্শকমহলে। তারপরই টার্নিং পয়েন্ট। জি বাংলার বহু আলোচিত মেগা ‘রাণী রাসমণি’-তে রাসমণির চরিত্রে দিতিপ্রিয়ার সহজাত ও বলিষ্ঠ অভিনয় তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। যদিও ধারাবাহিকে তাঁর বলা সংলাপ ‘তুমি এয়েচো’ নিয়ে শুরু হয় ট্রোলিংয়ের ঝড়। আরেক সংলাপ ‘রক্কে করো রঘুবীর’ নিয়েও হয় তৈরি হয় মিম।
এরই মাঝে ঘটে যায় আরও একটি ঘটনা। সেটি হল এক মাচা অনুষ্ঠানে দিতিপ্রিয়ার ‘কলঙ্কিনী রাধা’ গানটি গাওয়া। ট্রোলিংয়ের পাশাপাশি নেটিজেনদের অনেক কটু কথাই শুনতে হয় তাঁকে এ বাবদ। ততদিনে অনেকখানি পরিণত দিতিপ্রিয়া সেই সময় বলেছিলেন, “যাঁরা আমায় আঘাত করছেন, একদিন তাঁরাই আমায় বিখ্যাত করে দেবেন”। বাস্তবিক হয়েছেও তাই। দিতিপ্রিয়ার জনপ্রিয়তায় এতটুকু ভাঁটা পড়েনি। বরং তাঁর প্রাণোচ্ছ্বল স্বতস্ফূর্ত অভিনয় ক্রমশ সকলের মন জয় করে নিচ্ছে। শুভ্রজিৎ মিত্র পরিচালিত ‘অভিযাত্রিক’ ছবির হাত ধরে দীর্ঘসময় পর যখন বড়পর্দায় ফেরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপু, তখন তার স্ত্রী অপর্ণার চরিত্রে দেখা যায় দিতিপ্রিয়াকে। পরিচালক নাকি এই চরিত্রে তাঁকে ছাড়া আর কাউকে ভাবতেই পারেননি।
টলিপাড়ায় শুধু নয়, নিজের অভিনয় দক্ষতার গুণে বলিউডেও পা রেখেছেন দিতিপ্রিয়া। ইতিমধ্যেই সুজয় ঘোষের কন্যা দিয়া অন্নপূর্ণার ছবি ‘বব বিশ্বাস’-এ একটি ছোট চরিত্রের পাশাপাশি ডিজনি প্লাস হটস্টারে মাইক্রো অ্যান্থলজি ছবি ‘স্টোরিজ অন দ্য নেক্সট পেজ’-এ অভিষেক ব্যানার্জির মতো নামী অভিনেতার সঙ্গে দাপিয়ে অভিনয় করেছেন দিতিপ্রিয়া। পাশাপাশি ওটিটি-তেও পা রেখেছেন এই মেধাবী কন্যা। হইচইতে ‘রুদ্রবীণার অভিশাপ’-এর পাশাপাশি আগামী দিনে সুহোত্র মুখোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘ডাকঘর’-এ রয়েছেন তিনি। এছাড়াও জি ফাইভের ‘মুক্তি’-তে ঋত্বিক চক্রবর্তীর স্ত্রীর চরিত্রে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
আগামী দিনে তাঁর হাতে রয়েছে অনেক কাজ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অতনু বোসের ‘অচেনা উত্তম’, যেখানে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রে কাজ করছেন দিতিপ্রিয়া। এছাড়াও রয়েছে পাভেলের ‘কলকাতা চলন্তিকা’ এবং শুভ্রজিৎ মিত্রের ‘মায়ামৃগয়া’। সবমিলিয়ে বলাই যায় শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে ধীরে ধীরে নিজের অভিনয়ের রামধনু রঙ ছড়াচ্ছেন দিতিপ্রিয়া। আপাতত ‘আয় খকু আয়’-এর ‘বুড়ি’ রূপে পর্দায় কোন রঙের বিচ্ছুরণ ঘটান দিতিপ্রিয়া, আজ সেদিকেই চোখ থাকবে সকলের।