Monday, February 3, 2025
ওয়েব-Wave

ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক দলিল ‘মশলা কথা’

হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। আজ অবশ্য সিরিজ নয়। একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি নিয়ে লিখেছেন সোমনাথ লাহা

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি একটা সময়, দেশ স্বাধীনতার পথে। যদিও, তখন‌ও পর্যন্ত বাড়ির মহিলাদের জীবন আটকে ছিল রান্নাঘরের চারদেয়ালে। তাদের দুঃখ পুরুষ বোঝে না–এই আক্ষেপ ছিল বহু নারীর। বলা বাহুল্য, এই আক্ষেপ চিরন্তন। চিরন্তন এই ভাবনারই এক বিপরীত বার্তা আমরা পেলাম পরিচালক অরিন্দম শীলের স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘মশলা কথা’য়। এই ছবির আত্মাকে অনুভব করতে হলে দর্শককেও ফিরে যেতে হবে, সেই সময়টায়।

সেদিন এক পুরুষ প্রথম বুঝেছিলেন সারা দিন রান্নাঘরে বন্দি নারীর ব্যথা। মশলা বাটতে বাটতে তাঁদের হাতে কড়া পড়ে, চামড়া উঠে যায়, দেখেছিলেন নিজের চোখে। তাঁর সেই অভিজ্ঞতা থেকেই জন্ম নিয়েছিল গুঁড়োমশলা তৈরির ভাবনা। এই মানুষটির উদ্যোগে প্রথমে বাজারে এসেছিল গুঁড়ো হলুদ, যা কিনা রান্নায় সবচেয়ে জরুরি।

ছবিতে উঠে এসেছে, এক অল্পবয়সী বিধবা মহিলা কী করে স্বামীর অবর্তমানে পাঁচ সন্তানকে মানুষ করছেন। মাছ দিতে পারতেন না ছেলেমেয়েদের পাতে। পাতলা করে কাটা বেগুন ভাজা দিয়ে বলতেন, এটাই মাছ। বড় ছেলে যুধিষ্ঠির সেই ফাঁকি ধরতে পেরে আজীবনের জন্য মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। এক মায়ের আত্মত্যাগ অনুভব করেছিলেন তিনি। বিধবা মা, স্ত্রীর সারাক্ষণ রান্নাঘরে পড়ে থাকা ভাল লাগেনি তাঁর। যুধিষ্ঠির দত্ত। এই মানুষটির নারীর প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা, সর্বোপরি দূরদৃষ্টি কিভাবে বিপ্লব আনলো বাঙালির রান্নাঘরে, বাংলার ইতিহাসের সেই গল্প‌ই  উঠে এসেছে ‘মশলা কথা’য়। যুগকে অতিক্রম করে, আজ বাংলার ঘরে ঘরে পরিচিত ও সমাদৃত সেই নাম।

Image 4 1
ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক দলিল 'মশলা কথা' 3

গোটা মশলার ব্যবসা চালানোর পাশাপাশি যুধিষ্ঠির দত্ত নিয়ে আসেন গুঁড়োমশলা, যা আজ ব্যবহার করে বিশ্বের বহু দেশের নারী। যুধিষ্ঠির দত্তর দূরদৃষ্টির ফলস্বরূপ কিভাবে একটি স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়, এছাড়াও পরিস্থিতির কারণে কিভাবে অসহায়ত্ব কাটিয়ে তাঁরা ফিরে পান পুরোনো ব্যবসা–সেসব তো আছেই। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, এই কাহিনি আসলে একটি চিরন্তন বাঙালি মশলা প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট ব্র্যান্ড হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক যাত্রার দলিল। চরম প্রতিকূল অবস্থাতেও ঘুরে দাঁড়ানো, হাল না ছেড়ে লড়াই করা, নতুন কিছু করার ইচ্ছে, পরিবর্তনের উদ্যোগ–এইসব মশলা নিয়েই এমন এক ঐতিহাসিক কাহিনির বুনন ঘটিয়েছেন পরিচালক, যা বাঙালির হেঁশেলে এনেছিল আমূল পরিবর্তন।

ছবিতে যুধিষ্ঠির দত্তর চরিত্রে শুভ্রজিৎ দত্তের অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে। এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে ইশা সাহা, দেবযানী চট্টোপাধ্যায়, চন্দন সেন, অসীম রায়চৌধুরীর অভিনয় যথাযথ। বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় শিশুশিল্পী অঙ্কিত মজুমদারের কথা। বিক্রম ঘোষের আবহসঙ্গীত, মধুরা পালিতের সিনেমাটোগ্রাফি, সেট-কস্টিউম থেকে অন্যান্য অনুষঙ্গ দর্শকদের বিংশ শতাব্দীর কলকাতার বুকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। যাঁরা দেখেননি এখনও, তাঁদের জানাই, ইউটিউবেই রয়েছে এই ছবি। ‘মশলা কথা’ লিখে টাইপ করলেই দেখতে পাবেন। সকলের‌ই দেখা উচিত এই ছবি। কারণ ইতিহাসের এক অনন্য দলিলকে ধরে রাখার এক অসাধারণ প্রয়াস এটি, যা সাধুবাদযোগ্য।