Sunday, May 19, 2024
ওয়েব-Wave

‘মুক্তি’-তে কামাল করেছেন ঋত্বিক 

লিখেছেন মন্দিরা পান্ডা

ক্রিকেটের প্রতি ভারতীয়দের অবুঝ প্রেমে চাপা পড়ে আছে আর একটি আবেগ–ফুটবলপ্রেম। সেই প্রেম এখন আই-লিগ আর আইএসএলের মাধ্যমে কিছুটা উন্মোচিত হলেও একসময় ভারতে ফুটবলই ছিল শেষ কথা। ১৮৭৭ সালের সেপ্টেম্বরের এক দিন। ময়দানে ফুটবল খেলছিল ব্রিটিশ সৈন্যরা। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খালি পায়ে বলটা লাথি মেরে সৈন্যদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী। ভারতে ফুটবলের জনক নগেন্দ্র প্রসাদ, তাঁর স্ত্রী কমলিনী এবং বিপ্লবী ভার্গব উপাধ্যায়কে নিয়ে ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি ‘গোলন্দাজ’। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত দেব অভিনীত এই ছবি বাঙালির রক্তে নতুন করে উন্মাদনা তৈরি করেছে।

সেই রেশ কাটতে না কাটতেই এসেছে জাতীয়তাবোধ ও ফুটবলের গহীন যোগাযোগের আর এক কাহিনী ‘মুক্তি’। গত ২৬ জানুয়ারি, সাধারণতন্ত্র দিবসে ওয়েব প্ল্যাটফর্ম জি-ফাইভে রিলিজ করেছে ‘মুক্তি’। পরিচালকের আসনে রোহন ঘোষ। প্রযোজনা করেছে ফ্যাটফিশ। সিরিজের সঙ্গীত পরিচালনায় ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত।’ভিন্ন মত, এক পথ’–এটাই ‘মুক্তি’ ওয়েব সিরিজের মূল ভাবনা। আটটি এপিসোডে পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিন্ন লড়াইয়ের কাহিনি বলা হয়েছে, যা মূলত ফুটবলের ময়দানকে কেন্দ্র করে পল্লবিত। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ঋত্বিক চক্রবর্তী, অর্জুন চক্রবর্তী, দিতিপ্রিয়া রায়, সুদীপ সরকার, চান্দ্রেয়ী ঘোষ, চিত্রাঙ্গদা, সাহেব চট্টোপাধ্যায় এবং বিদেশি অভিনেতা কার্ল।

‘মুক্তি’ আসলে রামকিঙ্কর, দিবাকর, রহমত, মিনু, প্রভা এবং বিরোধী আলফ্রেড পেটির বর্বরতার ব্যক্তিগত লড়াই এবং সম্মিলিত বিপ্লবের গল্প। এক্ষেত্রে বন্দি এবং তাদের সহযোগীরা আদর্শগতভাবে ভিন্ন হলেও তাদের লক্ষ্য আসলে এক। নতুন জেল সুপার আলফ্রেড পেটির অধীনে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলের কয়েদিদের ওপর অত্যাচার ভয়াবহ আকার ধারণ করে। নব নিযুক্ত কারাধ্যক্ষ রামকিঙ্করের কয়েক দিন সময় লাগে, জেলের চার দেয়ালের মধ্যে ঘটে যাওয়া নৃশংসতা বুঝতে।

প্রথমে সে ভাবে, মনকে শক্ত করে, কোনও কিছুতে হস্তক্ষেপ না করে ব্রিটিশের একজন ভৃত্যের মতোই জীবনযাপন করবে। কিন্তু পরে তার কাছে বিষয়টা অসহ্য হয়ে পড়ে, প্রতিনিয়ত পেটি তাকে অপমান করার ফলে। এরপর ইংরেজদের কাছে কর্মরত জেল কারাধক্ষ্য রামকিঙ্কর স্বদেশি বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার অভিনব ফন্দি আঁটে। নিজেই তাঁদের হাতে তুলে দেয় ফুটবল। কীভাবে শাসক শ্রেণীর অস্ত্রেই তাদের শায়েস্তা  করে শোষিতরা, সেই নিয়েই এগিয়েছে গল্প।

রামকিঙ্করের চরিত্রকে কেন্দ্র করে মূলত নির্মিত হলেও সে যুগের সামাজিক অবস্থাও দেখানোর চেষ্টা করেছেন পরিচালক। রামকিঙ্কর (ঋত্বিক চক্রবর্তী) ও মিনুর (দিতিপ্রিয়া রায়) বিবাহিত জীবন, রামকিঙ্করের অন্তরের টানাপোড়েন, বিপ্লবীদের সংগ্রাম, ইংরেজদের অত্যাচার, আবার জেলের বন্দিদের দুর্দশা–এত কিছুর মধ্যেই রয়েছে ফুটবল ম্যাচ। আর তা মনে করিয়ে দিয়েছে আমির খানের ‘লগান’ এবং শাহরুখ খানের ‘চক দে! ইন্ডিয়া’র কথা।

‘মুক্তি’ নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত দিতিপ্রিয়া। ঋত্বিকের সঙ্গে পর্দা ভাগ করার জন্য মুখিয়ে থাকেন সব অভিনেতাই। দিতিপ্রিয়াও ব্যতিক্রম নন। তাঁর মতে, ‘‘দেশপ্রেম আর ঋত্বিকদা যেন মিলেমিশে একাকার। আশা করি, দর্শকদের খুবই ভাল লাগবে। ১৯৩১-এর গল্প হলেও কারাধ্যক্ষের স্ত্রী কিন্তু সেই আমলে যথেষ্ট আধুনিক ছিলেন। সেই সময়ের উচ্চারণ, হাঁটা, সাজ সবই অভিনয়ে ফোটাতে হয়েছে। কাজ করে ভাল লেগেছে।’’ আর অর্জুনের দাবি, ‘মুক্তি’র মুক্তি পাওয়ার উপযুক্ত তারিখ ২৬ জানুয়ারি ছাড়া আর কিছু হতেই পারতো না। শুধুই দেশ স্বাধীন করা লক্ষ্য নয়, সকলেরই লক্ষ্য প্রতি মুহূর্তে সেই স্বাধীনতা ভোগ করা। একুশ শতকে সেই কথাই ফের মনে করিয়ে দেবে এই নতুন সিরিজ। উল্লেখ্য, যেমন তাঁর অনুভব, তেমনই ঝকঝকে অভিনয়ও করেছেন অর্জুন।

থিয়েটার, টেলিভিশন, সিনেমা হয়ে ওয়েব সিরিজ–প্ল্যাটফর্ম যা-ই হোক, ঋত্বিক চক্রবর্তী বুঝিয়ে দেন তাঁর অপরিহার্যতা। ‘মুক্তি’-র ক্ষেত্রেও প্রতি পর্বে দর্শক এই উপলব্ধির জোয়ারে ভাববেন। বাংলা বিনোদনের এই সময়ের অন্যতম সেরা হয়ে উঠেছেন তিনি প্রতিভার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রমের গুণে। শুধু একটি কথা, এটি অবশ্য পরিচালকের ভাবার বিষয়। এই সিরিজে ঋত্বিকের মাথার উইগটি মোটেই মানানসই হয়নি–না চরিত্র, না প্রেক্ষাপটের হিসেবে ! রামকিঙ্কর প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যথার্থই বলেন তিনি,”চরিত্রটার দ্বন্দ্বটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে। এছাড়াও সেই সময়ের সমাজ, মানুষের ভাবনা বা তার বদল সমস্ত জিনিসকে খুব সাফল্যের সঙ্গে তুলে ধরেছে ‘মুক্তি’।” একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক পটভূমি, তার সঙ্গে টানটান চিত্রনাট্য ও দুর্দান্ত ক্লাইম্যাক্স–সর্বোপরি অভিনয়। ইতিমধ্যেই দর্শকের মন জিতে নিয়েছে ‘মুক্তি’।