প্রাগৈতিহাসিক মোড়কে মোড়া আজকের জীবন
দক্ষিণ আমেরিকার অ্যাপোলোচিয়ান পাহাড়ের আশেপাশে বাস করে আদিম যাযাবর জনগোষ্ঠি ক্রী। প্রকৃতি-নির্ভর মানুষ এরা। শিকার, জলার মাছ আর বনের ফলমূলই এদের বেঁচে থাকার উপজীব্য। প্রকৃতির ভাঁড়ারে টান পড়লে, তাঁবু গুটিয়ে এরা রওনা হয় অন্য কোনও গন্তব্য অভিমুখে, প্রকৃতিকে পুনরায় পরিপূর্ণ হওয়ার সময় দিয়ে। তাদের কাছে আমরা নাগরিক মানুষ শিখি পরিবেশ সংরক্ষণের প্রথম পাঠ।
বেরীর জঙ্গলে বেরী তোলার সময় এই দলের মেয়ে ওয়াপনুকে দেখে মনে ধরে হুরণদের ছেলে আতোহির। হুরণ লেকের ধারে তাদের বাড়ি, পথ ভুলে এসে পড়েছে ক্রীদের আস্তানায়। তারা কৃষিজীবি, তাই ক্রীদের তুলনায় মননে পেলব, নান্দনিক। ছেলেটি দক্ষ ধনুর্ধর। তাছাড়া ভালো বাঁশী ও ড্রাম বাজায়। কিন্তু বিধি বাম ! আতোহি ধরা পড়ে ক্রী শিকারীদের হাতে। দলের ধর্মগুরুরা ছেলেটিকে বলি দেবে মনস্থ করে। তৈরি হয় এক নাটকীয় তুঙ্গ মুহূর্ত। আজ যেমন যুদ্ধবিরোধী মানুষ জোট বাঁধছে রাজনৈতিক হত্যার বিরুদ্ধে, সেদিনও বিদ্রোহের ছোট-বড় স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে দলে। রদ হয়ে যায় বলি। তরুণ আতোহি প্রিয়াকে নিয়ে পালিয়ে যায় তার গাঁয়ে। প্রেমিকাকে বোঝায় কমিউনে যৌথ জীবনযাপনের তত্ত্ব, মাতৃতান্ত্রিক সমাজের রীতিনীতি।
এরপর এসে পড়ে কঠিন নিষ্করুণ শীত। বরফে ঢেকে যায় চারদিক। নতুন শিকার, জলার মাছ অপ্রতুল হতে থাকে। খাদ্যাভাব শুরু হয়। এইরকম এক তীব্র খাদ্যসঙ্কটের দিনে দলের একটি শিশু হারিয়ে যায়। জানা যায়, দলের ধর্মগুরু টুডু, যে এতদিন দলের সব্বার ভালোমন্দের জিম্মাদার ছিল, বলি দিয়েছে শিশুটিকে। প্রথমে প্রতিবাদ করলেও, পবে ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্ব মেনে, সবাই খায় বলির মাংস। এ লড়াই ছিল বাঁচার লড়াই । আর ধর্মগুরু নির্মম ছিল না, সে আদতে গোষ্ঠীর প্রতি, তার কর্তব্যের কাছে অবিচল।
ঘটে আরও কিছু। যে পিতা, দলপতি নিখ, হাতে করে শিকার শিখিয়েছেন তার সন্তান উকিসানকে, চিনিয়েছেন বনের উলুকসুলুক, আকালের সময় বুনো বাইসন মেরে দলের ক্ষিদে মিটিয়েছেন,পায়ে চোট লাগার পর দলের কাছে, সন্তানের কাছে তিনিও এখন বোঝা। একদিন গোষ্ঠীস্বার্থের দোহাই দিয়ে, শিকার করতে যাওয়ার অছিলায় বৃদ্ধ দলপতিকে ফেলে পালায় দলের সবাই। বৃদ্ধমানুষটি অপেক্ষা করতে করতে বুঝতে পারেন, কেউ ফিরবে না আর। ওরা তাঁকে ফেলে গেছে মৃত্যুর অপেক্ষায়।
আগামী ২৪শে নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় মিনার্ভা থিয়েটারে অভিনীত হতে চলেছে বালি নোটো নাট্যগোষ্ঠী প্রযোজিত নাটক ‘দিনান্তে’। নাট্যকার অলোক কুমার বসু। প্রয়োগ অমর চট্টোপাধ্যায় ও ময়ূরী মিত্র। আলো সুদীপ স্যান্যাল। মঞ্চ, আবহ ও রূপসজ্জা অমর চট্টোপাধ্যায়। নাটকটি যেন প্রাগৈতিহাসিক মোড়কে মোড়া আজকের জীবন। নিজেকে বাঁচাতে অন্যের ক্ষতি, উপকার ফুরোলেই উপকারী মানুষটিকে বাতিলের ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলা আমিকে আমরা খুঁজে পাবো নাটকের শেষে। হতে পারে, এক বিশ্রী ধরনের ঘ্যানঘ্যানে হ্যাংওভার নিয়ে ফিরবো বাড়ি। চেষ্টা করবো চ্যাটচ্যাটে মন খারাপটা ধুয়েমুছে ফেলতে। সম্ভব হবে না। প্রত্যেকদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের দেখা, যেখানে ঘাড়ের ওপর গরম নিশ্বাস ফেলবে আমাদের ঘুমন্ত, নাকি মরে যাওয়া বিবেক। নিজস্ব প্রতিনিধি