Monday, February 3, 2025
ওয়েব-Wave

বিয়ার গ্রিল: সংকল্পে ছিল এভারেস্ট জয়

ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে রঙিন এবং গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি বিয়ার গ্রিলের সঙ্গে ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’-এ অংশগ্রহণ করছেন―২০২০ সালে প্রদর্শিত ডিসকভারি নেটওয়ার্কের এই অনুষ্ঠান নিয়ে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে গিয়েছিল। যাওয়ারই কথা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তাঁর রাজনৈতিক জীবন যতই কঠিন সিঁড়িভাঙার অঙ্ক হোক, বিয়ার গ্রিলের এডভেঞ্চার সঙ্গী হওয়াটা একেবারে একটা অন্য মেরুর কান্ড। যাই হোক, তাতে নিখুঁতভাবে উত্তীর্ণ হন মোদিজি, যা আজ সবারই জানা। এ নিয়ে আর বিস্তারে যাব না। এই উত্তরণ তাঁর জনপ্রিয়তার মুকুটে আর একটি পালক যোগ করে এবং ডিসকভারি চ্যানেলও চুটিয়ে ব্যবসা করে নেয়–আসল কথা সেটাই।

Images 1 1

আমাদের প্রতিবেদন এই আসল কথার মূল চাবিটি যাঁর হাতে–এডভেঞ্চার, প্রকৃতিপ্রেমী আর বন্য-যাপন পাগল মানুষটিকে নিয়ে। তিনি ছাড়া যে এইসব চ্যালেঞ্জ শো-এর কিছুই হতে পারতো না! টিভি চ্যানেল থেকে আজকের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম–শো-এর নাম বা প্রেক্ষিত বদলেছে। বদলাননি সেই সকল কাজের কাজী বিয়ার গ্রিল। মোদিজি-র পর, রজনীকান্ত, অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগন বা ভিকি কৌশল–এ দেশের তাবড় একশন ও কঠিন স্টান্ট করায় অভ্যস্ত সুপারস্টাররা বিয়ার গ্রিলের ‘ইনটু দ্য ওয়াইল্ড’-এর সহযাত্রী হয়েছেন। চ্যানেল কর্তৃপক্ষের কথায়, থ্রিল, এন্টারটেইনমেন্ট আর এডভেঞ্চারের ডেডলি কম্বিনেশন এই শো। বলা বাহুল্য, এই ডেডলি কম্বিনেশনটি পরিকল্পনা স্তরেই যেতে পারতো না টিম বিয়ার গ্রিল ছাড়া।

এডভেঞ্চার, সায়েন্স, ওয়াইল্ড লাইফ, লাইফ স্টাইল ইত্যাদি নিয়ে নলেজ চ্যানেল ডিসকভারির রমরমা, শুরু থেকেই। ভারতীয় এবং তারপর প্রাদেশিক ভাষায় এর অনুষ্ঠানগুলি সম্প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদেশের দর্শক মহলেও বিপুল জনপ্রিয়তা পেল ডিসকভারি চ্যানেল। সেখান থেকে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। মুঠোফোনে ডিসকভারি প্লাস অ্যাপটি ইন্সটল করে নিলেই কেল্লা ফতে। যাবতীয় অচেনা, অদেখা অঞ্চল, জঙ্গল-নদী-পর্বত-সমুদ্রে বুকে শুট করা কঠিন থেকে কঠিনতর, এক-একটি হাড় হিম করা এডভেঞ্চার দর্শকের টাচ ফোন অর্থাৎ সহজেই চোখের নাগালে।

ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড বা ইনটু দ্য ওয়াইল্ড, যেটাই হোক, এই শো এবং বিয়ার গ্রিল একে অপরের পরিপূরক শুরু থেকেই। এডভেঞ্চার প্রিয় দর্শকের মুখে মুখে ফেরে তাঁর নাম। জন্মসূত্রে ব্রিটিশ এই মানুষটি একজন লেখক এবং টিভি প্রেজেন্টারও বটে। স্কুলের গন্ডি পার হওয়ার পর থেকেই হিমালয় পর্বতমালার বিভিন্ন অঞ্চল, মূলত সিকিম ও উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে বিচরণ শুরু গ্রিলের। সেদিক থেকে এদেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা হিমালয়ের সূত্রেই বেশ পুরোনো। ১৯৯৪-৯৭, তিন বছর কাটান তিনি এখানে। টেরিটোরিয়াল আর্মি ট্রেনিং তাঁর সাহস, দক্ষতা, চূড়ান্ত কঠিন পরিবেশের সঙ্গে যুঝবার ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

Images

তারপর সারভাইভাল ইন্সট্রাক্টর হিসেবে চলে যান উত্তর আফ্রিকায়। সেখানেই এক গুরুতর দুর্ঘটনার কবলে পড়া এবং বেশ কিছুদিন তাঁর প্রিয় এডভেঞ্চার জীবন থেকে দূরে থাকা। ঘটনাটি ঘটে কেনিয়ায়। অনেক উঁচু থেকে প্যারাশুটিং করাকালীন প্যারাশুট না খোলায় পড়ে যান তিনি। সারা শরীরই ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। সবথেকে বড় আঘাত, তাঁর মেরুদন্ডটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছিল সেই দুর্ঘটনায়। প্রিয় পাঠক, আমার কী সৌভাগ্য, এই দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে গ্রিলের মনের ভাবনা জানার সুযোগ পেয়েছিলাম এক এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে।

সেটা পুরোমাত্রায় টিভির জমানা। ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’ শুরু হবে। ডিসকভারি কর্তৃপক্ষ চাইলো, আমি যে পত্রিকাটির দায়িত্বে রয়েছি, সেখানে বিয়ার গ্রিলের একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হোক। বাংলা সান্ধ্য দৈনিকগুলির মধ্যে সেই পত্রিকা তখন সর্বাধিক বিক্রিত। ওরা বললো, প্রশ্ন তৈরি করে ওদের পাঠাতে। ওরা সেটা বিয়ার গ্রিলকে পাঠাবে এবং উত্তরও একইভাবে ওদের মাধ্যমে পৌঁছবে আমার কাছে। বিনোদন সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কলকাতা-মুম্বই মিলিয়ে সেলিব্রিটিদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার অভিজ্ঞতা তার আগেই হয়েছে। কিন্তু বিয়ার গ্রিলের ব্যাপারটা সবার থেকে আলাদা। ফলে, কী অপরিসীম রোমাঞ্চিত হলাম বুঝতেই পারছেন।

অনেকগুলি প্রশ্ন করেছিলাম। জবাবও দিয়েছিলেন তিনি। বহু বছর আগের কথা, সবই প্রায় ভুলে গেছি। কিন্তু একটি প্রশ্নের জবাব আজও ভুলিনি। এত এডভেঞ্চার করেছেন, তার মধ্যে একটি মনে রাখা অভিজ্ঞতা জানাতে বলেছিলাম। তিনি ওই দুর্ঘটনা প্রসঙ্গ ধরেই জানান, “অনেকটা উঁচু থেকে পড়ি। বাঁচারই কথা ছিল না। টানা দেড় বছর বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলাম। অনেকদিন পর্যন্ত বিছানাতেও পাশ ফিরতে অপরের সাহায্য লাগতো। মনে হতো, আর বোধহয় উঠে দাঁড়াতে পারবো না। এডভেঞ্চার করার তো প্রশ্নই নেই। তাহলে এই বাঁচার অর্থ কী ?”

কিন্তু অর্থ খুঁজে নিলেন তিনি। কী, সেটাও জেনে নিন গ্রিলের জবানিতেই―”আমি যখন স্কুলে, বেশ নিচু ক্লাসে, বাবা আমাকে এভারেস্টের একটা ছবি উপহার দিয়েছিলেন। তখন থেকেই স্বপ্ন এভারেস্টের চূড়ায় উঠবো। ছবিটা ছোটবেলা থেকেই বেশিরভাগ সময় আমার কাছে রাখতাম। শয্যাশায়ী অবস্থায় ছবিটা বালিশের নিচে রাখা থাকতো। যখনই হতাশ লাগতো, ছবিটা বের করে দেখতাম আর মনে মনে সংকল্প করতাম, উঠে দাঁড়াতেই হবে আমাকে। জয় করতেই হবে এভারেস্ট।” জয় করেছিলেন তিনি। সর্বকনিষ্ঠ এভারেস্ট জয়ী হিসেবে গিনেস রেকর্ডও গড়েছিলেন। ১৯৯৮-এর ১৬ মে শৈশবের স্বপ্ন পূরণ করেন বিয়ার গ্রিল, ২৩ বছর বয়সে।

Images 4

সংকল্প। এটাই এই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে বিয়ার গ্রিল প্রসঙ্গে বার বার মনে হচ্ছে। টিভি চ্যানেল থেকে আজকের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম–তাঁর সংকল্প, নিজেকে অবিচল রেখে লক্ষ্যে পৌঁছনো, চিনিয়ে দেয় এক ব্যতিক্রমী মানুষকে। যাবতীয় কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করার মধ্য দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেন দুঃসাহসী এই এডভেঞ্চারিস্ট। অনুপ্রাণিত করেন সমস্ত এডভেঞ্চার প্রিয় মানুষকে। সাহস ও আত্মবিশ্বাস যোগান তাদেরও, যারা মরতে মরতেও বেঁচে ওঠার স্বপ্ন দেখে, সে যে ক্ষেত্রই হোক।