ভয়াবহ আতঙ্কের সেই দিনটি ওয়েব সিরিজে
হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। আজ ‘মুম্বই ডায়রিজ ২৬/১১’ নিয়ে লিখেছেন মন্দিরা পান্ডা।
২০০৮ সালের ২৬শে নভেম্বর। ভয়াবহ জঙ্গী আক্রমণের সাক্ষী হয়েছিল মুম্বই। সংবাদ মাধ্যমে যার চলমান খবর দেখে কেঁপে উঠেছিল গোটা ভারতবর্ষ সহ সারা বিশ্ব। পাকিস্থানের সন্ত্রাসবাদী দল লস্কর-এ-তৈবার দ্বারা সংগঠিত সেই ঘটনা বহু মানুষের প্রাণহানি থেকে বিপুল সম্পত্তির ক্ষতির কারণ হয়। বিভীষিকার সেই কালো দিন আজও ভোলেনি দেশ। বিশেষত মুম্বই শহরকে তো প্রায় নতুন করে গড়তে হয়েছে নিজেকে। সেখানকার মানুষ আতঙ্কের প্রহর কাটিয়েছেন বহুদিন পর্যন্ত। বলা বাহুল্য, পরবর্তীকালে এই ঘটনার ফিকশন রূপ বার বার পর্দায় উঠে আসতে দেখি আমরা। নিখিল আদবানি ও নিখিল গঞ্জালভেস পরিচালিত ‘মুম্বই ডায়রিজ ২৬/১১’ তেমনই এক নিবেদন। আমাজন প্রাইমে ২০২১-এর ৯ই সেপ্টেম্বর মুক্তি পায় এই সিরিজ। ফিকশন হলেও এই সিরিজে রয়েছে এমন এক ভয়াবহ ও বাস্তব কাহিনিসূত্র, যা এক লহমায় আমাদের নিয়ে যায় ২০০৮-এর সেই আগুনে দিনটিতে।
অকুস্থল বোম্বে জেনারেল হাসপাতাল। কর্তব্যরত ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মী। ভয়ঙ্কর সেই কাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম, আহত অসহায় মানুষ, যাঁরা ওই সন্ত্রাস হামলার শিকার, তাঁদের পাশে থেকে দিবারাত্রির যুদ্ধ ! ‘মুম্বই ডায়রিজ ২৬/১১’ অবলীলায় আমাদের নিয়ে যায় স্মৃতির সেই আতঙ্কভরা পরিস্থিতিতে। হাসপাতালের অভ্যন্তর, সেখানে একদল হার না মানা মানুষের অসম যুদ্ধ ! দর্শক যেন সহজেই সম্পৃক্ত হয়ে যান এই ডাক্তার-নার্স ও হাসপাতালের বিভিন্ন কর্মীর সেই সময়ের অবস্থানের সঙ্গে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় কর্মরত মানুষগুলি নিজেদের যাবতীয় ক্ষমতা একত্রিত করে দাঁড়ান সেদিন শারীরিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে।
৮টি পর্বে (একটিই সিজন) তৈরি এই সিরিজের প্রথম এপিসোডে দেখা যায় দশ আতঙ্কবাদীর একটি দল জলপথে মুম্বই শহরে প্রবেশ করছে। অন্যদিকে হাসপাতালে কর্মরত এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে ওই বিষয়ে নানা তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে এক সাংবাদিক। সাংবাদিক খবর সংগ্রহ করে চলে যাওয়ার পরের মুহূর্তেই লিওপার্ড ক্যাফে-তে ঘটে যায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ। বোম্বে জেনারেল হাসপাতালের চেয়ারম্যানের মেয়ে ডাঃ দিয়া পারেখ। সে এবং আরও দুজন ডাঃ আহান মির্জা ও ডাঃ সুজাতা আজাওয়ালে ছিলেন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসকের দায়িত্বে। এছাড়া ছিলেন ট্রমা সার্জারি বিভাগের প্রধান ডাঃ কৌশিক ওবেরয়, যিনি হাসপাতালের সেরা চিকিৎসকদের অন্যতম। বলতে হয় হাসপাতালের সোস্যাল সার্ভিস ডিরেক্টর চিত্রা দাসের নামও। এই মানুষগুলি কীভাবে নিজেদের পেশার স্বার্থে জড়িয়ে পড়েন সেই সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা-পরবর্তী প্রেক্ষিতে–তাঁদের সকলেরই জীবনের মোড় ঘুরে যায় এই একটি ঘটনায়।
বোম্বে জেনারেল হাসপাতালের পাশাপাশি তাজমহল প্যালেস হোটেলে যে বিধ্বংসী হামলা হয় সেদিন, সেটাও উঠে আসে সিরিজে। এখানে আমরা পাই আর এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অনন্যা ঘোষকে, যিনি ডাঃ কৌশিক ওবেরয়ের স্ত্রী এবং তাজমহল হোটেলের ফুড অ্যান্ড বেভারেজ সার্ভিস বিভাগের প্রধান। বিখ্যাত সাংবাদিক বলিউড বাবল-এর ভাবনা আগরওয়াল এই ওয়েব সিরিজকে ৫-এ ৩.৫ রেটিং দেন। সত্যি বলতে কী, ওঁর মন্তব্যের সঙ্গে পূর্ণ সহমত হয়ে বলা যায়, মেডিকেল ড্রামা হিসেবে ‘মুম্বই ডায়রিজ ২৬/১১’-এর অনন্যতা অনস্বীকার্য। রিয়েল লাইফ এই ড্রামার চিত্রনাট্য রচনায় সম্পূর্ণ সফল এর লেখক টিম। কৃতিত্বের অধিকারী নিখিল গঞ্জালভেস, অনুষ্কা মেহরোত্রা, যশ চেতিজা ও সংযুক্তা চাওলা শেখকে (সংলাপ) কুর্নিশ জানাতেই হয়। সবার ওপরে পরিচালক হিসেবে নিখিল আদবানি। বলিউডে তাঁর জায়গাটা যথেষ্ট ব্যতিক্রমী। ২০০৩-এ ‘কাল হো না হো’-র মতো ছবির হাত ধরে পরিচালনায় অভিষেক ঘটে তাঁর। তার আগে বহু বিখ্যাত পরিচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন নিখিল। পরে বহু হিট ও নানারঙের ছবি উপহার দেন নিখিল দর্শককে। এই সিরিজেও নির্মাতা রূপে তাঁর ভিন্নধারার ভাবনা অভিব্যক্ত।
দৃশ্যপট ও চরিত্রগুলির বিন্যাসে যথেষ্ট গবেষণা, যত্ন ও নিষ্ঠার পরিচয় মেলে। প্রধান চরিত্রগুলি হলো ডাঃ কৌশিক ওবেরয় (মোহিত রায়না), চিত্রা দাস (কঙ্কনা সেনশর্মা), অনন্যা ঘোষ (টিনা দেশাই), ডাঃ দিয়া পারেখ (নাতাশা ভরদ্বাজ), ডাঃ আহান মির্জা (সত্যজিৎ দুবে), ডাঃ সুজাতা আজাওয়ালে (ম্রুন্ময়ী দেশপান্ডে), ভিজিটিং প্রফেসর ডাঃ সাহিল আগরওয়াল (মিশাল রাহেজা), সাংবাদিক মানসী হিরানি (শ্রেয়া ধন্বন্তরী)। এছাড়াও বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রকাশ বেলাওয়াড়ি, ঋষভ অরোরা, বালাজি গৌরী, সোনালি কুলকার্নি, পুষ্করাজ চিরপুটকর, বিক্রম আচার্য, সোনালি সচদেব ও আলেখ কাপুর প্রমুখ। প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা। তাঁদের রিয়ালিস্টিক অভিনয় এই সিরিজের প্রাণ। বিশেষত, মোহিত রায়না, টিনা দেশাই, কঙ্কনা সেনশর্মা, সোনালি কুলকার্নি ( এটিএস চিফ অনন্ত কেলকারের স্ত্রী) অতুলনীয়। যাঁরা এখনও এই সিরিজ দেখেননি, তাঁরা অবশ্যই দেখবেন। না দেখলে আক্ষেপ থেকে যাবে, গ্যারান্টি।