অসমাপ্ত কাহিনির নতুন অভিমুখে ব্যোমকেশ
সাতের দশকের অশান্ত সময় মিলে গেছে সত্যান্বেষীর অন্বেষণে। সেই প্রেক্ষিতেই অরিন্দম শীলের ‘ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ’। লিখেছেন সোমনাথ লাহা।
সাতের দশকের প্রেক্ষাপটে তৈরি পরিচালক অরিন্দম শীলের ‘ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ’। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা অসমাপ্ত ব্যোমকেশ কাহিনি ‘বিশুপাল বধ’-কে অবলম্বন করে নির্মিত এই ছবি। ‘ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ’ হলো অরিন্দম নির্দেশিত চতুর্থ ব্যোমকেশ চিত্র। সাতের দশকের উত্তাল নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আবর্তিত হয়েছে এই ছবি। পাশাপাশি সেই সময়ের বাংলার নাট্যজগতও এই ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রসঙ্গত, অরিন্দম ইতিপূর্বে যতগুলি ব্যোমকেশ চিত্র নির্মাণ করেছেন, প্রতিটিতেই লেখকের লেখা অনুসরণ করে চিত্রনাট্যকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু, এবার পরিচালক নিজেই কলম ধরেছেন। কারণটা স্পষ্ট। ‘বিশুপাল বধ’ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সমাপ্ত করে যাননি। অগত্যা, গল্প ও চরিত্র দুটোকেই নিজের মতো করে গড়েপিটে নিয়েছেন অরিন্দম। এরই পাশাপাশি তিনি এও জানিয়েছেন এটিই তাঁর পরিচালিত শেষ ব্যোমকেশ ছবি হতে চলেছে।
এসভিএফ এবং ক্যামেলিয়া প্রোডাকশনের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এই ছবির চরিত্রদের রূপ ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এনেছে প্রযোজনা সংস্থা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে চুলে পাক ধরেছে ব্যোমকেশের। অস্থির এই সময়ে ব্যোমকেশের পরিবারে আগমন ঘটতে চলেছে নতুন অতিথি–সত্যবতী সন্তানসম্ভবা। অজিতের লুকও বেশ পরিণত। লেখালিখি ছেড়ে এবার প্রকাশনার কাজে মন দিতে চায় সে। এই বিষয়ভাবনাকে মাথায় রেখেই ব্যোমকেশ, সত্যবতী ও অজিতকে নিয়ে আসা হয়েছে পর্দায়। চার বছর বিরতির পর আবার বড় পর্দায় ফিরছে ব্যোমকেশ। সেই কারণেই ব্যোমকেশ ও তার পরিবারের সদস্যদের খানিকটা পরিণত বয়েসী করে তুলেছেন পরিচালক।
প্রসঙ্গত, আবীর ও সোহিনী অপরিবর্তিত থাকলেও ‘ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ’-তে অজিতের ভূমিকাভিনেতা বদলেছে। এটা অবশ্য আগেও দুবার ঘটেছে। অরিন্দমের প্রথম দুটি ব্যোমকেশ চিত্রে অজিত চরিত্রে ঋত্বিক চক্রবর্তী এবং তৃতীয় ব্যোমকেশ চিত্রে রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন। এবারে অজিত হয়েছেন সুহোত্র মুখোপাধ্যায়। শরদিন্দুর এই অসমাপ্ত কাহিনির বাকি অংশ সহ বেশ কিছু নতুন চরিত্রের বুনন এই ছবিতে ঘটিয়েছেন পরিচালক। তার মধ্যে অন্যতম হল সুলোচনা। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন পাওলি দাম। সুলোচনা এমন একজন অভিনেত্রী, যিনি সাতের দশকে বাংলা বাণিজ্যিক থিয়েটারে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করতেন। মঞ্চ ও তার বাইরে বেশ কয়েকটি আলাদা লুকে দেখা যাবে পাওলিকে।
এক নবাগতা অভিনেত্রীর চরিত্রে দেখা যাবে অনুষা বিশ্বনাথনকে। সেই সময়কার বাংলা নাট্যমঞ্চ যাকে এক্সপ্লয়েট করে। বিহার থেকে কলকাতায় আসা মেয়েটিকে নামিয়ে দেওয়া হয় ক্যাবারেতে। অচিরেই সে হয়ে ওঠে ক্যাবারে ড্যান্সার সোমালিয়া। আসলে দরিদ্র পরিবারের অনেক মেয়েকেই সেই সময় ক্যাবারের রাস্তা বেছে নিতে হত। সেই সংস্কৃতিই বাংলা নাট্যমঞ্চের একাংশে ছেয়ে গিয়েছিল। ছবিতে তার রেফারেন্সও রয়েছে। এছাড়াও ছবির অন্যতম দুই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বিশুপাল ও ব্রজদুলাল। বিশুপালের চরিত্রটিতে রয়েছে একাধিক শেড। সেই চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যাবে কিঞ্জল নন্দকে। ছবিতে তাঁর চরিত্রটির বয়সের মধ্যে চোদ্দো বছরের ব্যবধান দেখানো হবে। দুটি আলাদা লুকে দেখা যাবে কিঞ্জলকে। ব্রজদুলালের ভূমিকায় রয়েছেন অর্ণ মুখোপাধ্যায়। সেই চরিত্রেও রয়েছে একাধিক শেড। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছেন লোকনাথ দে (কালীচরণ), পদ্মনাভ দাশগুপ্ত (প্রতুলবাবু), অসীম রায়চৌধুরী (পুলিশ অফিসার মাধব মিত্র) প্রমুখ।
‘ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ’-র চিত্রনাট্য লিখেছেন পদ্মনাভ দাশগুপ্ত ও অরিন্দম যৌথভাবে। সংগীত পরিচালনায় রয়েছেন বিক্রম ঘোষ। সিনেমাটোগ্রাফার অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। সম্পাদনায় সংলাপ ভৌমিক। প্রসঙ্গত, ব্যোমকেশ কাহিনিকে নিজের মতো করে চালনা করার এতখানি স্বাধীনতা এর আগে পাননি অরিন্দম। এবার তাই পরিচালক হিসেবে তাঁর কাছে চ্যালেঞ্জটাও অনেক বেশি। অসমাপ্ত কাহিনিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার জন্য রীতিমতো রিসার্চ করেছেন পরিচালক ও তাঁর টিমের সদস্যরা। আগেই বলেছি, এবারের কাহিনির প্রেক্ষাপট নকশাল আন্দোলন। ১৯৭১-এ যখন নকশাল আন্দোলনের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে, সেই সময় ব্যোমকেশ, সত্যবতী ও অজিতকে সঙ্গে নিয়ে একটি নাটক দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই নাট্যমঞ্চেই ঘটে যাওয়া একটি হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয় সে। এই প্রেক্ষিতেই ছবিতে উঠে আসবে বাণিজ্যিক থিয়েটারের জগৎটা। বাংলা থিয়েটারের এই পর্যায়টি নিয়ে এর আগে সেভাবে কাজ হয়নি। সে কারণে ডকুমেন্টেশন নেই। ফলে, অনেক তথ্য খুঁজে নিয়ে চিত্রনাট্যের বুনন করতে হয়েছে তাঁদের।
৪০ শতাংশ লেখা কাহিনিকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন অরিন্দম। শরদিন্দুর লেখা এই কাহিনিতে নকশাল আন্দোলনের একটা আভাস ছিল, সেটিকে বড় করে এই ছবিতে মেলে ধরেছেন পরিচালক অরিন্দম শীল। টলিউডে আবীর চট্টোপাধ্যায়কে বড়পর্দায় প্রথমবার ব্যোমকেশ হিসেবে অঞ্জন দত্ত হাজির করলেও তাঁর পূর্ণাঙ্গ রূপ তথা ব্যোমকেশ হিসেবে দর্শকদের মধ্যে পরিচিত ও জনপ্রিয়তার পিছনে পুরোধা যে অরিন্দম শীল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘হর হর ব্যোমকেশ’, ‘ব্যোমকেশ পর্ব’, ‘ব্যোমকেশ গোত্র’ প্রতিটি ছবিতেই আবীর-অরিন্দমের রসায়নে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শক। রীতিমতো যত্ন সহকারে ব্যোমকেশ কাহিনিগুলিকে পর্দায় মেলে ধরেছেন পরিচালক।
ছবির কাস্টিং নিয়ে পরিচালক অরিন্দম শীলের মন্তব্য, “ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ-এ সবচেয়ে অসাধারণ কাস্টিং হয়েছে, যা কোনও ব্যোমকেশের ছবিতে আগে দেখা যায়নি। আমার এই নতুন ব্যোমকেশ ছবিতে আমি ১৯৭১-র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দুটি বিষয়কেই মেলে ধরেছি। এটি ব্যোমকেশ সিরিজের অন্যতম আকর্ষণীয় ছবি হতে চলেছে।” স্মার্ট নির্মাণ, ঝকঝকে ফ্রেম, দুরন্ত গতির ব্যোমকেশ সিরিজ টিম অরিন্দম শীলের ট্রেডমার্ক। সঙ্গে আবার বাঙালির চিরন্তন আবেগের সাতের দশক। ফলে, এই ছবি নিয়ে টানটান অপেক্ষায় বাংলার দর্শক। আগামী ১১আগষ্ট প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে ‘ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ’।