সাইকোলজিক্যালি ইমব্যালেন্সড কোনও নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করতে চাই
তাঁর অভিনয় পেশা ও যাপনের আরও নানা বিষয়ে একান্ত কথায় টেলিTalk-এ বাংলা টেলিভিশনের জনপ্রিয় অভিনেতা সৌরভ চ্যাটার্জি। সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন অজন্তা সিনহা।
একযুগের বেশি সময় পার হয়ে গেল। গত ১৬ বছর ধরে টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত আছি। তার আগের সময়টায় শুধু থিয়েটার। অভিনয়ই প্যাশন। বরাবর এটাই করতে চেয়েছি। পেশাদারীভাবে অভিনয়টাই করব, সেটা হয়তো ভাবিনি। তাই যখন সেটা ঘটল, মনে হলো বিরাট একটা আশীর্বাদ পেলাম। সত্যি কথা বলতে কী, এই পেশাকে কেন্দ্র করে যতটুকু পেয়েছি, তার বেশিরভাগটাই আমার সম্পদ। প্রচুর গুণী মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি, অভিনয় পেশার কারণেই।
পাশাপাশি কিছু অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতাও হয়তো হয়েছে। একেবারে শুরুর দিকে কিছু মানুষের ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছি। ভুলিনি সেসব কথা। মনে পড়ছে, একজন মেকআপ আর্টিস্ট বলেছিলেন, আগে পাঁচ বছর যাক, তারপর তো অভিনেতা ! ততদিন টিকলে হয় ! তবু বলব, বেশিরভাগটাই ভালো কেটেছে। যন্ত্রনা যেটুকু, তা উৎকৃষ্ট শিল্পচর্চায় উন্নীত না হওয়ার। অভিনয়ের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো, এক জীবনে অনেকগুলো মানুষের জীবনকে যাপন করা। Stanislavski-র given circumstances (the plot, the facts, the incidents, the period, the time and place of the action, the way of life) মেনে নিয়েও সেই মুহূর্তে সেই মানুষটার (পড়ুন অভিনীত চরিত্র) মতো হয়ে ওঠার ব্যাপারটা ভারি মজার।
আমার না ভোলা চরিত্রগুলির মধ্যে প্রথমেই বলব, ‘এখানে আকাশ নীল’-এর জুনিয়র ডাঃ সৌরভের কথা। এছাড়াও ভীষন ভালো লাগা চরিত্র ‘গানের ওপারে’-র উত্তীয় দেব ওরফে বুবাই। এই সূত্রেই দুদিন প্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষের সাহচর্যে কাজ করার সুযোগ ঘটেছিল। বুবাই ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়। তথাকথিত ভাবে বড় চাকরিবাকরির চেষ্টা করাটাই স্বাভাবিক ছিল। তবে, রেস্তোরাঁ ব্যবসা তার প্যাশন। তাই বাড়ির অমতে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে সে রেস্তোরাঁ খোলে, নাম খাই খাই। এখানেই গোরা আর পুপে প্রথম পাবলিক পারফর্ম করে। পরে খাই খাই রেস্তোরাঁতেই গোরা আর পুপের প্রেম হয়। এই ধারাবাহিকে আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার দৃশ্যটি–যেখানে মাকে চিঠি লিখে চলে যাওয়ার একটি সিকোয়েন্স ছিল। এই দৃশ্যটি আমার বাবাকে (রিল নয় রিয়েল) খুব স্পর্শ করেছিল। বাবার অমত ছিল, আমার অভিনয়কে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে। আমার সেই সদা গম্ভীর বাবার মন ভিজে গিয়েছিল দৃশ্যটি দেখে। এ এক বিরাট প্রাপ্তি !
না ভোলা চরিত্রগুলির মধ্যে উল্লেখ করব ‘গোয়েন্দা গিন্নি’-র টাবলু, জীবনে প্রথম ডাবল রোল–একজন ভালো, অপরজন দারুণ মন্দ। সাহানা(দত্ত)দি-কে ধন্যবাদ এমন সুযোগের জন্য। দারুণ এক অভিজ্ঞতা। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল কাজটা। বলতে ইচ্ছে করছে, ‘মিঠাই’-এর লাভগুরু রাজীব কুমারের কথা–এই চরিত্রটা আমার কেরিয়ারের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। আমার শৈশবে বাবা-জেঠাদের মধ্যে স্নেহময় যে ছায়াটা দেখেছি, তারই কিছু শেড। আবার হাসিখুশি স্বভাবের আড়ালে বাবা না হতে পারার যন্ত্রনা লুকিয়ে রাখা–সব মিলিয়ে অসাধারণ এই কাজটি করার অভিজ্ঞতা। এমন সুযোগ, কাজের অপার স্বাধীনতা–সবকিছুর জন্য রাখীদি (শাশ্বতী ঘোষ) ও রাজেনদার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব আমি। মজার কথা হলো, ‘মিঠাই’-তে আমার প্রায় ন’টা লুক ছিল। এই চরিত্রটি করে দর্শকের কাছেও প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছিলাম।
এই মুহূর্তে ‘সন্ধ্যাতারা’-য় দুষ্টু মেজকাকা রিন্টুর চরিত্রে অভিনয় করছি। সে একটি গ্রাম্য, চতুর, অলস ভাবনার বদলোক। চেহারাটি এমন–গুঁফো, শার্ট আর লুঙ্গি পরে, কাঁধে গামছা, হাঁটাচলা হাতির মতো থপথপে–’মিঠাই’-এর লাভগুরু রাজীব কুমারের একেবারে উল্টো। বলা বাহুল্য, কাজটা করতে খুব মজা পাচ্ছি। এই যে একেবারে বিপরীত পথে চলা একটি চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা–এটাই তো অভিনেতার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ! এটাই তো আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ! একটা কথা এই প্রেক্ষিতে জানাই, পছন্দসই চরিত্র সবসময় আমরা অভিনেতারা যে পাই, সেটা নয়। কিন্তু জীবিকার তাগিদেই সেটা করতে হয়। চেষ্টা করি, পরিস্থিতি যেমনই হোক, কাজটায় যেন ফাঁকি না থাকে।
আমার স্বপ্নের চরিত্র অনেক। যেমন, শেকসপিয়রের হ্যামলেট, পথের দাবী’র সব্যসাচী। কোনও এক নক্সালাইট চরিত্রে কাজ করার ইচ্ছে হয়। এছাড়া গিরীশ ঘোষের চরিত্র বা সালভাদর দালি ! খুব চাই, সাইকোলজিক্যালি ইমব্যালেন্সড কোনও নেগেটিভ চরিত্র করতে। এছাড়া পেশায় ব্যারিস্টার, এমন একটি চরিত্রেও কাজ করতে চাই। আছে আরও অনেক কিছু। সত্যি বলতে কী, এই ব্যাপারে আমি ভয়ানক লোভী। চাহিদার কোনও শেষ নেই !
পর্দার বাইরে আমি আদ্যন্ত একজন ফুর্তিবাজ, মিশুকে ও সামাজিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব সচেতন মানুষ। আমি কাশিপুর এলাকায় থাকি। কাশীপুর ক্লাব সমন্বয় সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি আমি। কাশীপুরের সমস্ত ক্লাব নিয়ে তৈরি এই সমন্বয় সমিতি। ক্লাবের তরফ থেকে আমরা ফুটবল টুর্নামেন্ট করি। এলাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতিসাধন আমার স্বপ্ন। এছাড়া, টালিগঞ্জের বন্ধুদের নিয়ে একটি এনজিও-ও গঠন করেছি, নাম
HERE TO CARE–মূলত বৃক্ষরোপণই আমাদের লক্ষ্য। সারা রাজ্যে এক লক্ষ গাছ রোপণ করা টার্গেট আমাদের। এছাড়াও নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত আমি। পুজোয় বেশ কয়েকজন মানুষকে জামাকাপড় দিলাম আমরা।
প্রবল পেটুক একজন মানুষ বলতে পারো আমায়। দারুণ প্রিয় পাঠার মাংস। আর ইলিশ-চিংড়ি তো চেটেপুটে খাই। ফুটবলে মোহনবাগান আর আর্জেন্টিনার একনিষ্ঠ ভক্ত। প্রিয় দলের সমর্থনে তর্ক-ঝগড়ায় ক্লান্ত নই আমি। পছন্দের মানুষদের সঙ্গে পার্টিও ভালো লাগে। সবাইকে হাসাতে ভালোবাসি। কারোর দুঃখ দেখলেই, চেষ্টা করি, তাকে সব ভুলিয়ে, হাসাতে।
ফ্যাশনের ক্ষেত্রে আমি বহুমুখী। তবে, আমার বিশেষ পছন্দ ভিন্টেজ স্টাইল। স্যুট, জিন্স-টি শার্টও ভালো লাগে। আর ফ্যাশনের প্যাশনে আমি পুরোদস্তুর বাঙালি। সাদা ধুতি আর চিরায়ত বাঙালি শার্ট চাইই চাই উৎসবে, বিশেষ উপলক্ষে। রঙিন ধুতি আমার পছন্দ নয়, অবাঙালি মনে হয়। অভিনেতা না হলে কী হতাম ? অবশ্যই একজন সাংবাদিক এবং বেছে নিতাম ক্রাইম বিট !
পুজো সেলিব্রেশন অনেকটাই বদলে গেছে। আগে খুব ঘুরতাম। এরপর একটু বয়স বাড়লে শুরু হলো বন্ধুদের বাড়িতে আড্ডা। তবে, গত চার বছর ধরে পুজোয় আমি বেড়াতে যাই। প্রসঙ্গত, আমি যেহেতু বেশ কয়েকটি পুজোর আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত আছি, তাই, পুজোর অনেক আগে থেকেই পুজো সংক্রান্ত কাজকর্ম শুরু হয়ে যায়। সেই ব্যাপারটাও দারুণ উপভোগ করি।
***অভিনেতার social media account
Sourav_success
Sourav Chatterjee