Sunday, May 19, 2024
টেলি-Talk

কাশ্মীরকে আমি হৃদয়ে বহন করি

লেখালেখির উৎস, অর্থাৎ, ঠিক কবে বুঝতে পারলে, লেখালেখি তোমার যাপনের এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়াবে?

✒️ সেটা ১৯৯৬ সাল। চাকরি-বাকরি করি তখনও। চাকরির যা নিয়ম, কিছুদিন পরই একঘেয়েমি ঘিরে ধরে। খানিকটা একঘেয়েমি কাটাতেই সেই সময় ছোটগল্প লিখতে শুরু করি। লেখক সত্ত্বার বীজটা নিশ্চয়ই কোথাও সুপ্ত ছিল, যা আমার ক্ষেত্রে দিক নির্দেশকের কাজ করল। এটা খুব ভালো মনে আছে, বাবা-মা খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, প্রথম দিকে সেটা খুবই জরুরি ছিল।

প্রথম গল্প প্রকাশের অভিজ্ঞতা–

✒️ সেটা ২০০৪-৫ সাল হবে। কলকাতার বিখ্যাত এক ম্যাগাজিনে প্রথম আমার লেখা গল্প প্রকাশিত হলো। যেটা কোনোদিন ভুলব না, গল্পটা প্রকাশিত হওয়ার পর ফোন করলেন প্রয়াত সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য। খুব প্রশংসা করলেন গল্পের। আর বললেন, লেখাটা ছেড়ো না। বুঝতেই পারছ, এটা আমার কাছে কত বড় প্রাপ্তি সেইসময় ! শুধু সেই সময় কেন, আজও মনে পড়লে রোমাঞ্চিত, অনুপ্রাণিত হই।

লেখাটা চালিয়ে যাবার পক্ষে আরও কিছু উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটল !

✒️ তা ঘটল। আর্টিস্ট ফোরামের ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় বছরে দু’বার। সেখানে নিয়মিত লেখা শুরু হলো। এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকেও লেখার আমন্ত্রণ পাচ্ছিলাম। অভিনয় জগতের বাইরে একটা অন্য ভুবনের দরজা খুলে যাচ্ছিল ক্রমশ।

এই সময় থেকেই কী অনুভব করলে, লেখালেখি তোমার অভিনয় জীবনের সমান্তরালে এগিয়ে চলবে ?

✒️ বলতে পারো। সত্যি কথা বলতে কী, আমরা অনেককিছুই জীবনে পরিকল্পনা করি না। কিন্তু ঘটে যায়। লিখতে ভালবাসতাম। কিন্তু সেই ভালোবাসা যে পাঠকের স্বীকৃতিও পাবে, সেটা প্রথমে অলীক স্বপ্নই ছিল। যেটা বলার, পাঠকরাই আমায় সেই স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। ২০১০-এ প্রকাশিত হলো আমার প্রথম গল্পের বই ‘বন্ধু’। ৫টা ছোটগল্পের সেই সংকলন প্রকাশ করল মনিকুন্তলা পাবলিকেশন।

তাহলে টার্নিং পয়েন্ট এটাই ?

✒️ আসলে বিশেষ কোনও সময় বা ঘটনা যে আমার লেখক হওয়ার দিকে এগিয়ে দিয়েছে, অত নির্দিষ্টভাবে সেটা বলা যায় না। একে এক চলমান প্রক্রিয়া বললেই ঠিক হবে। তার মধ্যেও যে সময়টা থেকে একেবারে ধারাবাহিক ভাবে লেখালেখি শুরু করলাম, সেটা সেপ্টেম্বর ২০২২, মানে গত বছর। মাঝে মাঝেই একটা ভাবনা আসা-যাওয়া করত মনে–চারপাশে এত জীবন, সেখানে এত গল্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেসব আঁজলা ভরে সৃষ্টির ঝুলিতে কুড়িয়ে নিলেই গল্পদের চলা শুরু হয়ে যায়। হলোও তাই। এরপরই ১২টি গল্প সমন্বিত ‘বীথিকা কেবিন‘ প্রকাশিত হলো ঘরে বাইরে পাবলিকেশন থেকে।

এ যাবৎ ক’টা বই প্রকাশিত হয়েছে তোমার ?

✒️ ৫টা বই। যার মধ্যে কাশ্মীরের ওপর লেখা ‘অন্য উপত্যকা‘ অভাবনীয় সাড়া ফেলে দেয়। আমার লেখক পরিচিতিকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয় এই বই।

কাশ্মীর। এবার আমরা এই প্রসঙ্গেই কথা বলব। আমার প্রশ্ন, কেন কাশ্মীর ?

✒️ কেন কাশ্মীর, তার ব্যাখ্যায় প্রথমেই বলব, এ যেন ডেস্টিনি। কাশ্মীর এক ব্যতিক্রমী অনুভব ! এই অনুভবই আমায় ‘অন্য উপত্যকা‘ লেখায় উদ্বুদ্ধ করে। ২০১৯ সালে প্রথম কাশ্মীর যাই। আদতে আমার শুটিংয়ের জন্য যাওয়ার কথা ছিল আমেরিকা। ভিসা নিয়ে কিছু সমস্যা হওয়ায় বাবাকে বললাম, কাশ্মীর যাব। যাই হোক, যাওয়া তো হলো। কিন্তু সময়টা অমরনাথ যাত্রার, সেই উপলক্ষে দারুণ ভিড়। পেট্রোল পাম্প, মুদির দোকান সর্বত্র লাইন। তারমধ্যে ওই আর্টিকল ৩৭০ অপসারণের ফলে কাশ্মীরের পরিস্থিতি আচমকাই বেশ অশান্ত। অতএব পড়িমরি করে কলকাতায় ফিরে আসলাম। ফিরে এলাম ঠিকই। বলতে পারো কাশ্মীরকে হৃদয়ে নিয়ে ফিরলাম। ঠিক করলাম, সুযোগ পেলেই আবার যাব।

কাশ্মীরের সঙ্গে প্রাণের মিলন এখান থেকেই শুরু তাহলে !

✒️ ঠিক তাই। এরপর এলো কোভিড পরিস্থিতি। লকডাউন চালু হলো। খানিকটা অবকাশ পেলাম। প্রথমেই ভাবলাম, কাশ্মীর নিয়ে কিছু করতে হলে, ওখানকার ভাষাটা শিখতে হবে। অনলাইন শিখতে শুরু করলাম কাশ্মীরি ভাষা কাশীর (Kasheer)। বেশ কঠিন, তবু, রপ্ত করলাম। ওদের গানও শিখলাম। প্রসঙ্গত বলি, কাশ্মীরি তরুণ গোলাম মোহম্মদের কথা। আজ সে আমার ভাই না বন্ধু, বলতে পারি না। বোধহয় দুইই। প্রথমবার গিয়েই তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। কাশ্মীরের অন্তরাত্মার অনুসন্ধানে ও আমায় দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করে।

বুঝতেই পারছি, গোলাম মোহম্মদ তোমার ক্ষেত্রে সেতুর কাজ করল।

✒️ ঠিক তাই। ২০২১-এর এপ্রিলে আবার গেলাম কাশ্মীর। ভালোবাসতে শুরু করলাম নানা বিতর্কে জর্জরিত ভূস্বর্গকে। এরপর কাশ্মীরে আরও ৫ বার গেছি আমি। তবে, দ্বিতীয়বারেই গোলামের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। যেদিন কাশ্মীর পৌঁছই, তার পরদিনই ওর বাড়িতে থাকতে গেলাম। এখন তো ওর পরিবারের মানুষজনও আমার আত্মীয়। এখানে একটা কথা, ওদের অন্দরমহল বা রান্নাঘরে কিন্তু বহিরাগতরা প্রবেশাধিকার পায় না। আমার প্রাপ্তি, গোলাম ও তার পরিবারের বাকিরা আমায় প্রায় শুরু থেকেই বহিরাগত বলে মনে করেনি।

এই যে আত্মিক সম্পর্ক, এটা ব্যাক্তিগত প্রাণিত হওয়ার দিক। কিন্তু ‘অন্য উপত্যকা‘ লেখার পিছনে তো একটি নির্দিষ্ট গবেষণা পর্ব রয়েছে।

✒️ সে তো বটেই। তবে, এটা ঠিক পরিকল্পনা মাফিক গবেষণা নয়। বরং বলা যায়, অনেক বেশি অনুভবী বীক্ষণ। এক্ষেত্রেও আমি গোলামের কথাই বলব। ও না থাকলে কাশ্মীরের অন্তরাত্মা আবিষ্কার করতে পারতাম না আমি। আমি একেবারে ওদের যাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম। এমনকী কলকাতায় যে কাশ্মীরি শালওয়ালারা আসেন, তাঁদের সঙ্গেও কথাবার্তা বলেছি। এভাবেই তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। ২০২৩-এ কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হলো ‘অন্য উপত্যকা‘। প্রকাশক বসাক বুক স্টোর্স। ২০২৩-এর আগস্ট মাসে প্রকাশিত হলো ‘মহারানী দিদ্দা‘, প্রকাশক ঘরে বাইরে পাবলিকেশন।

তোমার কলমে একটি রহস্য কাহিনিও তো পল্লবিত হয়েছে।

✒️ হা। একটু স্বাদ বদল বলতে পারো। দীপ প্রকাশন থেকে বের হয়েছে ‘শ্রীকান্ত মঞ্জিলের রহস্য‘। আমার ছোটবেলা, মানে, ১৯৮২ সালের কথা। তখন ভবানীপুর থাকতাম। সেখানকার একটা বাড়ির স্মৃতিকে ঘিরে এই গল্পটি পল্লবিত। আমার এই বইগুলি প্রকাশের ক্ষেত্রে একটা বিষয় উল্লেখ্য, প্রকাশকরাই এক সৌহার্দপূর্ণ মনোভাব নিয়ে আমার লেখাকে পাঠকের দরবারে নিয়ে গিয়েছেন। লেখক হিসেবে কোথাও এভাবেই আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, উৎসাহ পেয়েছি বারবার।

অভিনেতা বা সিনেমা জগতের নামী মানুষজন সচরাচর ক্রিয়েটিভ লেখাই লেখেন। তুমি সাহিত্যকে বেছে নিলে। এটা কী স্বতোৎসারিত ?

✒️ একবারেই তাই। সাহিত্য আমার দক্ষিণের জানালা। আমার মুক্তির আকাশ।

ভবিষ্যতে ইন্ডাস্ট্রির অন্দরমহল নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে আছে ?

✒️ জানি না। আপনা থেকে কিছু ভাবনা এলে, তবেই সেটা ঘটতে পারে। আমি মূলত ছোট গল্প লিখতেই সবচেয়ে ভালোবাসি। অবসেসড বলতে পারো। যদিও, উপন্যাস লেখার অফারই বেশি পাই। ছোটগল্পের তেমন বাজার নেই। এবার বেশ কয়েকটি শারদীয়া পত্রিকায় কিছু ছোটগল্প লিখেছি। সেসব নিয়েও পরে হয়তো কোনও সংকলন প্রকাশ করা যেতে পারে। এমনিতে লেখার মধ্যেই এখন অনেকটা যাপন। জীবনকে দেখি, চেটেপুটে নিই মানুষ আর পরিবেশের সবকিছু। বাকি কথা বলা মন, কালি ও কলমে।