Sunday, May 19, 2024
টলিউডলাইম-Light

এবার ভালো ছবির পাশে দাঁড়াতে হবে লগ্নিকারীদের

নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। নিছক স্লোগান হয়েই রইলো,’বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান’! লিখেছেন সোমনাথ লাহা

সিনেমার বিষয় বা বক্তব্য যদি জোরালো না হয়, তাহলে ছবির চিত্রনাট্য ও তার প্রয়োগপদ্ধতির মধ্যেও খামতি থাকতে বাধ্য ! এর ফলে, স্বাভাবিকভাবেই দর্শক সেই ছবির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে না। দর্শক গ্রহণ না করলে সেই ছবি বক্স অফিসে কামাল করবে কী করে ? শুধুমাত্র মার্কেটিং বা প্রচার কখনও‌ই যথেষ্ট নয়, একটা ছবির বক্স অফিসের আনুকূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে। সাম্প্রতিক মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছবি ‘ডক্টর বক্সী’ ও ‘দিলখুশ’ প্রসঙ্গে এই কথাটি যথাযথ ভাবেই প্রযোজ্য। কাঙ্ক্ষিত পরিণতিই ঘটেছে ছবি দুটির ক্ষেত্রে। দর্শক মুখ ফিরিয়েছে।

কিন্তু কেন এই পরিণতি, কী সেই কারণ–যে প্রচুর অর্থব্যয় করে, ঢাকঢোল পিটিয়েও এই ছবিগুলি দর্শক আনুকূল্য পেল না ? বিষয়গুলি এবার খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। শুধুমাত্র গালভরা বিজ্ঞাপনের মতো ‘বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান’ বলে দিলেই দর্শক ছবির পাশে দাঁড়াবেন না। এই সহজ সত্যটা বোধ করি বাংলা ছবির নির্মাতা-লগ্নিকারীদের বোঝার সময় এসেছে।   সপ্তাশ্ব বসুর ছবি ‘ডক্টর বক্সী’ বক্স অফিসের নিরিখে রীতিমতো বিপর্যস্ত একটি ছবি। অপরদিকে রাহুল মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘দিলখুশ’-এর‌ও বক্স অফিসে ফলাফল আশানুরূপ নয়। এক‌ইদিনে দুটি ছবি‌ই মুক্তি পেয়েছে। প্রসঙ্গত সেই দিন টিকিটের দামে বিশেষ অফার থাকলেও লাভের লাভ হয়নি। বরং লাভ হয়েছে মিঠুন চক্রবর্তী ও দেব অভিনীত ছবি ‘প্রজাপতি’-র। ছবিটি ইতিমধ্যেই বক্স অফিসে ঘোষিত ব্লকবাস্টার।

বরং এই দুই ছবির তুলনায় কিছুটা হলেও ভালো জায়গায় রয়েছে একই দিনে মুক্তিপ্রাপ্ত কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ছবি ‘কাবেরী অন্তর্ধান’।  ছবিটি দর্শক ও সমালোচক উভয়েরই প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ ছবির বেশ কয়েকটি শো হাউজফুল‌ও হয়েছে। পরিণত ফ্যামিলি অডিয়েন্স, যাঁরা সিরিয়াস ছবি দেখতে পছন্দ করেন, তাঁরা সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছেন এই ছবি। সাতের দশকের নকশাল আন্দোলন ও ১৯৭৫-এর এমার্জেন্সির  প্রেক্ষাপটে আবর্তিত এই ছবি পছন্দ করেছেন তাঁরা।

মূলত সরস্বতী পুজো, নেতাজি জন্মজয়ন্তী ও প্রজাতন্ত্র দিবসের কথা অর্থাৎ এই ছুটির সপ্তাহটিকে মাথায় রেখেই ছবিগুলি মুক্তি পেয়েছিল। এমতাবস্থায় ২৫ জানুয়ারি মুক্তি পায় শাহরুখ খান অভিনীত ‘পাঠান’, তিনদিনেই যে ছবির বক্স অফিস কালেকশন ৩০০ কোটির ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। এখন তো প্রায় চ্ক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে তাঁর সাফল্যের গতি। হলমালিকরাও লাভের আশায় বলিউডি ছবিটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।  তারমধ্যেও কমসংখ্যক হল পেয়েও, শহরতলীর একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শকের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে কৌশিকের ছবি। কারণ ছবির বিষয়বস্তু, চিত্রনাট্যর মুন্সিয়ানা। অন্যদিকে ‘ডক্টর বক্সী’ ও ‘দিলখুশ’ সেটি করতে সক্ষম হয়নি।

প্রথমেই ধরা যাক ‘ডক্টর বক্সী’-র কথা। পরিচালক সপ্তাশ্ব বসুর এই মেডিক্যাল থ্রিলারের মধ্যে রয়েছে সায়েন্স ফিকশনের ছোঁয়া। ছবির গল্প বেশ অন্যরকম। কিন্তু পরিবেশনে গোলমাল। সেটা এতটাই যে সাধারণ দর্শক খেই হারিয়ে ফেলে। মধ্যান্তর অবধি দর্শক ধরতেই পারে না, ছবির গল্প ঠিক কোনদিকে গড়াচ্ছে। তারপর গল্পের আভাস পাওয়া গেলেও ততক্ষণে সবটাই ঘেঁটে গিয়েছে। গল্পে নতুনত্ব, অন্য ধরনের বিষয় থাকলেও ছবির চিত্রনাট্য বারবার গল্প বলার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সেই কারণেই ছবি দেখার মজাটাই নষ্ট হয়ে যায়। শহুরে দর্শক এই ধরনের পরীক্ষামূলক ছবি দেখতে অভ্যস্ত হলেও, তারা এখনও সংখ্যায় সীমিত। বিশেষত, বাংলা ছবিতে তারা এই ধরনের বিষয় দেখতে অভ্যস্ত নয়। 

এক্ষেত্রে দোষটা দর্শকের নয়। নির্মাতারা যথাযথভাবে বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। থ্রিলারের ক্ষেত্রে আর একটি কথা প্রযোজ্য, এখানে চিত্রনাট্য স্মার্ট ও  টানটান হওয়া একান্ত জরুরি। ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, বনি সেনগুপ্ত ও শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়। দর্শকদের হলমুখী করতে অক্ষম হয়েছেন ওঁরা। পরমব্রত এখন ওটিটিতে বেশ কিছু কাজ করছেন। আর বনির তো একটা ছবির পর আরেকটা ছবি মুক্তির অপেক্ষায় থাকে। এঁরা দুজনেই সহজলভ্য হয়ে গিয়েছেন দর্শক আঙিনায়। শুভশ্রী দক্ষ পরিচালকের হাতে পড়লে ভালো অভিনয় করেন। এখানে সেটাও হয়নি। সব মিলিয়েই ছবি ফ্লপ।

এবার আশা যাক ‘দিলখুশ’-এর কথায়। এসভিএফের মতো বড় প্রযোজনা সংস্থা এই ছবির প্রযোজক। এই ছবিটি তৈরি করা হয়েছে নতুন প্রজন্মের দর্শকদের কথা মাথায় রেখে। যদিও, রাহুল মুখোপাধ্যায় পরিচালিত এই ছবিটি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে কোন‌ও আকর্ষণ তৈরি করতে পারেনি। কারণ, এই ছবির বিষয়বস্তু বা প্রেজেন্টেশন তাঁদের সেই এক্স ফ্যাক্টরটি দিতে সক্ষম হয়নি। এমনিতেই তাদের সামনে বিনোদনের প্রচুর অপশন রয়েছে। ফলত, বাংলা ছবি এক অর্থে কিছু টার্গেট অডিয়েন্সের বৃত্তেই ঘোরাফেরা করছে। সেই কারণেই পারিবারিক ছবি হ‌ওয়ার কারণে ‘কর্ণসুবর্ণের গুপ্তধন’, ‘প্রজাপতি’-র মতো ছবিগুলি বক্স অফিসে আনুকূল্য পেয়েছে। 

‘দিলখুশ’ ছবিটি মূলত দিলখুশ নামক ডেটিং অ্যাপকে ঘিরে চার জোড়া  মানুষের প্রেমের টানাপোড়েন। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনসূয়া মজুমদার, খরাজ মুখোপাধ্যায়,  অপরাজিতা আঢ্য, সোহম মজুমদার, মধুমিতা সরকার, ঐশ্বর্য সেন, উজান চট্টোপাধ্যায় অভিনীত এই ছবির তাবড় অভিনেতারা নজর কাড়বেন সেকথা জানাই ছিল। কিন্তু ছবির চিত্রনাট্য টানটান জমাটি নয়। বরং বেশ কিছু বিষয় ছবিতে অস্পষ্ট। বেশ কিছু দৃশ্য চিত্রনাট্যের সমর্থন পায় না। এমনকি চরিত্রগুলোর সঙ্গে সেভাবে দর্শকরাও একাত্মবোধ করেন না।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই ধরনের ছবিতে সংগীত খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা পালন করে। প্রেমের গানে ভরপুর এই ছবির গান‌ও সেভাবে চার্টবাস্টার হয়নি। শহর-গ্রামে সেভাবে ঘরে ঘরে বাজবে, এমন গান এই ছবির নয়। বাংলা ছবিতে একসময় যে কাজটি জিৎ গঙ্গোপাধ্যায় করেছিলেন। বরং সবকটি গান কতদিন মানুষের মন জুড়ে থাকবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। মধুমিতা, সোহম ভালো অভিনেতা। ঐশ্বর্য সে অর্থে নবাগতাই। এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে তাঁকে। মোটকথা, মধুমিতা বা ঐশ্বর্যকে দেখার জন্য দর্শক সিনেমাহল পর্যন্ত আসবেন, এতখানি জনপ্রিয় মুখ‌ও তাঁরা নন। সবকিছুর ফলস্বরূপ ইয়াং স্টার থেকে ফ্যামিলি ও বয়স্ক দর্শকও এই ছবি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমনকী চল্লিশোর্ধ দর্শকরাও এই ছবির প্রতি আলাদা আকর্ষণ অনুভব করেননি।

এখানে একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, মফস্বল, গ্রামের সিঙ্গেল স্ক্রিন দর্শকরাই তারকা তৈরি করেন। কোন‌ওদিন‌ই মাল্টিপ্লেক্স নতুন তারার জন্ম দেয় না। ‘দিলখুশ’-এর বিষয় দর্শকের মনোমত না হ‌ওয়ায় নতুন নায়ক-নায়িকা তৈরি হ‌ওয়াটাও প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়াল। একটা সময় ‘চিরদিন‌ই তুমি যে আমার’ মতো ছবির হাত ধরেই রাহুল ও প্রিয়াঙ্কার মতো নতুন প্রতিভারা উঠে এসেছিলেন। গত কয়েক বছরে সেরকম ভাবে বলার মতো কোনও নতুন মুখ না পাওয়াও ইন্ডাস্ট্রির পক্ষে একটা নেতিবাচক দিক। এরপরও এই জাতীয় ছবি তৈরির জন্য প্রযোজক মেলে।

কিন্তু, যে সমস্ত পরিচালকরা ছবি তৈরির বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট প্যাশনেট, দক্ষ ও প্রতিভাবান, তাঁদের ছবি তৈরির জন্য প্রযোজকরা সেভাবে এগিয়ে আসেন না। সেই কারণেই স্ত্রীর গহনা সহ অন্যান্য সামগ্রী বন্ধক দিয়ে কুমার চৌধুরীর মতো পরিচালককে ‘প্রিয় চিনার পাতা ইতি সেগুন’ তৈরি করতে হয়। ছবি দর্শকের আনুকূল্য, প্রশংসা পেলেও প্রেক্ষাগৃহ পায় না। ইন্দ্রাশিস আচার্য-র ছবি ‘নীহারিকা’ দেশে ও বিদেশের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত হলেও, এখানে সিনেমাহলে মুক্তির জন্য অর্থ সংকুলান করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় পরিচালককে। উক্ত ছবিগুলোর বিষয়ভাবনা, চিত্রনাট্যের মধ্যে গভীরতা থাকা সত্ত্বেও, এমনটাই ঘটে চলে। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ‘দোস্তজী’-র পাশে না দাঁড়ালে, কী হতো বলা মুশকিল। দর্শক বঞ্চিত হতেন প্রসূন চট্টোপাধ্যায়ের এই অসাধারণ ছবিটি দেখা থেকে। অথচ প্রেক্ষাগৃহ আগলে থাকে এমন ছবি, যেগুলির বিষয়ের গভীরতা নেই। সূত্রের খবর, প্রথম সপ্তাহে সেভাবে ব্যবসাই করতে পারেনি ‘ডক্টর বক্সী’ ও ‘দিলখুশ’। তারপরও হল জোড়া করে ছিল এই ছবিগুলি। কী করে, সেকথা জানেন প্রযোজক আর এখানকার জটিল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম।