Sunday, May 19, 2024
টলিউডলাইম-Light

কাবুলিওয়ালার প্রত্যাবর্তন : নব যুগে, নব রূপে

নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। টলিউডের বাজার গরম মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত ‘কাবুলিওয়ালা’ নিয়ে। লিখেছেন প্রিয়রঞ্জন কাঁড়ার

জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চলচ্চিত্রের সম্পর্কটা অনেকটা অম্লমধুর ছিল। এই বিষয়ে জেমস জয়েসের সঙ্গে তাঁর অদ্ভুত মিল ছিল। এঁদের দু’জনের কেউই সিনেমার ভক্ত ছিলেন না। অথচ, সিনেমা শিল্পকে নিয়ে দু’জনেরই কৌতূহল ছিল ষোলো আনা। প্রবাসী জীবনে একবার রাস্তায় হলিউডি অভিনেত্রী মেরি পিকফোর্ডকে ঘিরে গণ-হিস্টিরিয়া দেখে রবি ঠাকুর যথেষ্ট বিরক্তি ও তাচ্ছিল্য সহকারে মন্তব্য করেছিলেন, “ভবিষ্যতে হয়তো কোনও ক্রীড়াবিদ মুষ্টিযোদ্ধাকে নিয়ে এই ব্যাপার ঘটবে।” আসলে সাহিত্যের মতোই সিনেমাও যে ভবিষ্যতে যে কোনও মননশীল ভাবনার সুযোগ্য ও স্থায়ী বাহন হয়ে উঠতে পারে, এই বিশ্বাস তাঁর খুব একটা ছিল না। তাঁর কাছে সিনেমা ছিল নিছকই ‘চলমান চিত্রমালার দৃশ্যাড়ম্বর ও চমক সৃষ্টির প্রবণতা’।

আবার নির্বাক ছবির যুগে শিশির কুমার ভাদুড়ির ছোট ভাই মুরারী ভাদুড়ির উদ্দেশে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “উপকরণের বিশেষত্ব অনুসারে কলারূপের বিশেষত্ব ঘটে। আমার বিশ্বাস ছায়াচিত্রকে অবলম্বন করে যে নূতন কলারূপের আবির্ভাব প্রত্যাশা করা যায়, এখনও তা দেখা দেয়নি। ছায়াচিত্র এখনও পর্যন্ত সাহিত্যের চাটুবৃত্তি করে চলেছে। তার কারণ কোনও রূপকার আপন প্রতিভার বলে তাকে এই দাসত্ব থেকে উদ্ধার করতে পারেনি, করা কঠিন। কারণ, কাব্য বা চিত্র বা সঙ্গীতে উপকরণ দুর্মূল্য নয়। ছায়াচিত্রের আয়োজন আর্থিক মূলধনের অপেক্ষা রাখে, শুধু সৃষ্টি শক্তির নয়।”

এই প্রবল সংশয় ও অবিশ্বাসের মধ্যেও রবি ঠাকুর স্বয়ং সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন, সিনেমা পরিচালনাও করেছেন। দ্য ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্মস কোম্পানি প্রযোজিত ও ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘তপতী’ (রবীন্দ্র নাটক অবলম্বনে) ছবিতেই চলচ্চিত্রাভিনয়ে রবি ঠাকুরের হাতেখড়ি। ছবির প্রোটাগনিস্ট বিক্রমদেবের চরিত্রে অভিনয় করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আট রিলের এই নির্বাক ছবির শুটিং হয় এবং ওই মাসেই ছবিটি মুক্তি পায়। রবীন্দ্র সাহিত্য-নির্ভর প্রথম সবাক ছবির পরিচালক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজে। ১৯৩২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথ পরিচালিত ‘নটীর পূজা’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরা।  

এরপর সময়ের অমোঘ নিয়মে রবীন্দ্রসাহিত্য হয়ে উঠেছে বাংলা সিনেমার এক মূল্যবান ধারা। ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্প অবলম্বনে তপন সিংহ পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৭ সালের ৪ জানুয়ারি তারিখে। নাম ভূমিকায় ছবি বিশ্বাসের অনবদ্য অভিনয় আজও স্মরণীয়। মিনির চরিত্রাভিনেত্রী টিঙ্কু ঠাকুরের একটি রেকর্ড আজও অটুট। মিনির চরিত্রে অভিনয়ের সময় টিঙ্কুর বয়স ছিল সাড়ে চার বছর। রবীন্দ্র সাহিত্য-নির্ভর কোনও ছবিতে আজ পর্যন্ত এত কম বয়সে কেউ অভিনয় করেননি। সেই সময়ের চলচ্চিত্রে উৎস সাহিত্যকে খুব একটা ভাঙাচোরা করার রেওয়াজ ছিল না। তাই রবীন্দ্রনাথের বর্ণনা আর তপন সিংহের চিত্রায়ণের খাত ও অববাহিকা অভিন্ন।

তারপর ৬৬টি বসন্ত পেরিয়ে গিয়েছে। সিনেমার ভাষা ও শৈলি যেমন বদলেছে, ঠিক তেমনই বাঙালি জীবন ও আফগান জীবনের খোলনলচেও পাল্টেছে ব্যাপকভাবে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত এক আফগান পিতার মনোরাজ্যের হালহকিকত এবং আফগান-নব্য বাঙালির সম্পর্কের পরিবর্তিত রসায়ন খুঁজে বের করে, তবেই একজন পরিচালকের পক্ষে নতুন যুগের উপযোগী ‘কাবুলিওয়ালা’ নির্মাণ সম্ভব। আর এই কঠিন কাজেই হাত দিয়েছেন পরিচালক সুমন ঘোষ। এবার নামভূমিকায় মিঠুন চক্রবর্তী। যে অভিনেতা একজন অর্ধনগ্ন আদিবাসী যুবকের চরিত্র (মৃগয়া) পেরিয়ে বলিউডের হার্টথ্রব এবং ন্যাশনাল ক্রাশ হয়ে উঠতে পারেন, কাবুলিওয়ালার মতো চরিত্রে বোধহয় একমাত্র তাঁকেই মানায়। নবযুগের দ্বিধা-সংশয়ের মেঘে আচ্ছন্ন পিতৃহৃদয়ে মহাগুরু কীভাবে অবগাহন করেন, সেটাই এই আসন্ন ছবির ইউএসপি হতে চলেছে।

শোনা যাচ্ছে, কলকাতা, লাদাখ ও আফগানিস্তানের মাটিতে চলবে শুটিং পর্ব। ২০১২ সালে মিঠুন শেষবার সুমন ঘোষের পরিচালনায় কাজ করেছিলেন ‘নোবেল চোর’ ছবিতে। ১১ বছর পর আবার সেই অভিনেতা-পরিচালক জুটির প্রত্যাবর্তন। এছাড়া প্রযোজনা সংস্থা এসভিএফের ব্যানারে মিঠুনের শেষ অভিনয় ‘রকি’ ছবিতে। এটি মিঠুনের জ্যেষ্ঠপুত্র মিমোর অভিষেক ছবি হলেও বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু এসভিএফ ও মিঠুনের পারস্পরিক আস্থা যে তাতে এতটুকুও টোল খায়নি, তার প্রমাণ হতে চলেছে এই ছবি। অন্যান্য কাস্টিং এখনও চূড়ান্ত হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই মিনির ভূমিকায় কে অভিনয় করবেন, তাই নিয়েও বিস্তর জল্পনা রয়েছে। ছবি বিশ্বাসের রহমত আজও আমাদের হৃদয় জুড়ে। মিঠুনের সামনে এ এক তীব্র চ্যালেঞ্জ ! একই কথা টিঙ্কু ঠাকুরের মিনি প্রসঙ্গেও প্রযোজ্য। তার কথাও যে না-ভোলা হয়ে রয়েছে। আপাতত এই যাবতীয় আবেগ সহ বাঙালির অপেক্ষা কাবুলিওয়ালার জন্য।