Sunday, May 19, 2024
টলিউডলাইম-Light

মৃণাল সেনের সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি ‘পালান’ এক শ্রদ্ধার্ঘ

নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। প্রাক পুজোয় বেশ কয়েকটি বাংলা ছবি মুক্তির অপেক্ষায়। যদি বলি, তার শুরুটা আজই হয়ে গেল ‘পালান’-এর মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে, তাহলে বাড়িয়ে বলা হবে না। লিখেছেন চারুবাক

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের যে কোনও ছবিকে কেন্দ্র করেই বাংলা ছবির দর্শকদের মধ্যে একটা বাড়তি আগ্রহ ধূমায়িত হয়ে ওঠে। তবে, ‘পালান’ সবদিক থেকেই একেবারে ভিন্ন এক গুরুত্বে আলোচনায়। কৌশিকের কাছে আটের দশকে তৈরি মৃণাল সেনের ‘খারিজ’ তাঁর সবচাইতে প্রিয় ছবি। শতবর্ষে শ্রদ্ধা জানাতে তাই কৌশিক ‘খারিজ’-এর সিক্যুয়েল বানিয়েছেন! সেটা অস্বীকারও করেননি! তবে এই ছবির আরও বেশি সমসাময়িকতা হলো, কলকাতা শহরের শিক্ষিত নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালির আত্মসম্মানবোধ, প্রতিবাদী চেতনা এবং লড়াকু মনোভাবের পুনর্নির্মাণ!

গত পঞ্চাশ বছরে বাঙালি অসৎ উপায়ে সাময়িক প্রাপ্তির ঝুলি ভরাতে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির পায়ে নতজানু হয়েছে। জীবন ধারণের অংশ হিসেবে মাথা উঁচিয়ে নয়, মেরুদন্ড ভেঙে স্বার্থের কাছে নীতিশিক্ষা সম্ভ্রম–সব জলাঞ্জলি দিয়েছে! মৃণাল সেনের প্রতিবাদ ছিল এই মানসিক অবনমনের বিরুদ্ধে! কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় সেই আদর্শকে আবার ফিরিয়ে আনতে চেয়েই বানিয়েছেন এই নতুন ‘পালান’ ! ‘খারিজ’-এ কাজের ছেলে কিশোর পালান বন্ধ ঘরে বিষাক্ত গ্যাসের প্রতিক্রিয়ায় মারা যায়! অঞ্জন সেন (অঞ্জন দত্ত)কে সেদিন আমরা অপরাধবোধে আক্রান্ত হতে দেখি, যা তার ওপর চেপে বসে থাকে স্থায়ীভাবে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে সেই অঞ্জন এখন ওই একই ১২/সি/১ বেলতলা রোডের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে বিছানায়।

এখন বাড়িটি গ্রাস করতে চায় প্রতিবেশী বন্ধু(?) প্রোমোটার সমীর (বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) ! না, অসহায় বৃদ্ধের প্রতি তার কোনও দায় নেই। কোনওভাবে অঞ্জনের পরিবারকে সরিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে! একদার আট ভাড়াটিয়া এখন এসে ঠেকেছে দুটি পরিবারে! একটি পরিবারকে সমীর প্রায় ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে, অঞ্জনের প্রতিবাদ সত্বেও। বাকি শুধু অঞ্জন ও স্ত্রী মমতা ( মমতা শঙ্কর)। এহেন পরিস্থিতিতে পুরনো বাড়িতে এক রাত্রে হঠাৎই পড়ে গিয়ে অঞ্জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এই সুযোগ। বাড়ি পুরো খালি। সমীর থানা-পুলিশ, স্থানীয় নেতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে অঞ্জন-মমতাকে উচ্ছেদ করতে উদ্যোগী হয়!

অঞ্জন বুঝতে পারেন ছেলে পুপাই (যীশু), বৌমা (পাওলি) তাদের নতুন ফ্ল্যাটে অকুলান সত্বেও, বাবার নতুন বিছানা ‘ফাওলার’-কে জায়গা করে দিতে ছোট্ট নাতনির ঘরে ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটবে তার। না, সেটা তিনি হতে দেবেন না। বলে ওঠেন “নাতনির বিছানায় কেউ হাত দেবে না!” এবং তারপর অশক্ত শরীর নিয়ে বৃদ্ধ অঞ্জন যে কাণ্ডটি করেন, সেটাই ‘পালান’-এর ক্রাক্স পয়েন্ট বা মুহূর্ত! মৃণাল সেনের অপরাজেয় প্রাণশক্তি, প্রতিবাদী মেজাজ ফিরে আসে ছবির নির্বাক শেষ ফ্রেমটিতে! মৃণাল সেনের ছবিতে যেমন গল্প বা ঘটনার চাইতে বেশি জায়গা নেয় চলমান জীবনের মুহূর্তমালা, এখানেও কৌশিক একইভাবে সাজিয়েছেন পুরনো ভেঙে পড়া বাড়িতে দুই বৃদ্ধবৃদ্ধার জীবন এবং প্রতিবেশী টাক্সি চালক হরি, শ্রীলা (শ্রীলা মজুমদার), সমীরের জীবনের সঙ্গে তাঁদের আত্মিক সম্পর্ক! আর হাজরার বাড়ি ছেড়ে ছেলে-বৌমার নতুন সংসারের সঙ্গে তাঁদের বন্ধন পর্বটিও বুনেছেন সিমলেস ভাবেই। একটাই শুধু মৃদু অনুযোগ–যীশু-পাওলির ঘনিষ্ট দৃশ্যটির সংযোজন! প্রয়োজন ছিল না একেবারেই!

কৌশিকের ছবিতে শিল্পীরা কেমন অভিনয় করবেন, সেটা আর উল্লেখ করার দরকার পড়ে না। তবুও বলবো, অঞ্জন দত্ত পুরো শরীর দিয়ে পিটার ওয়াইজের মারাত সাদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন! অনবদ্য তিনি। মমতা শঙ্কর ঠিক তাঁর নিজের ওজন বুঝে সেরাটি দিয়েছেন। যীশু ও পাওলি মেড ফর ইচ আদার দম্পতি–বেশ গুডিগুডি মার্কা, স্বাভাবিক ও সহজ-সরল! ‘খারিজ’-এর হরি (দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত ) বড়ো হয়ে শুধু ট্যাক্সিচালক নয়, সংবেদনশীল এক প্রতিবেশীও, যা আজকের দিনে ডোডোপাখি! তাঁর অভিনয়ে কমিকের ছোঁয়া দর্শকের বাড়তি পাওনা। সমীরের চরিত্রে বুদ্ধদেব আজকের স্বার্থপর প্রোমোটারের ভূমিকাটি সুন্দর ফুটিয়েছেন। চিত্রনাট্যে শ্রীলা মজুমদারের অবস্থা কিছুটা যেন ‘বেচারি’র মতো! অবশ্য, তিনি আর কী-ই বা করবেন ! উজান গঙ্গোপাধ্যায়ের গানটি ভালো লাগে! আর সবচাইতে বড়ো প্রাপ্তি হলো, কৌশিকের তরফ থেকে মৃণাল সেনের আপোষহীন প্রতিবাদ ও সমমান পুনরুদ্ধারে স্তিতধী থাকার পুরনো মেজাজ ফিরিয়ে দেওয়া !!