Saturday, May 18, 2024
ওয়েব-Wave

ভদ্রলোকের মুখোশ খুলে দেবে ‘ছোটলোক’

একটি বহুতল আবাসন। আবাসনের ফ্ল্যাটগুলিতে বাস করে তথাকথিত ভদ্র জনতা। এক সকালে সেখানে খুন হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় এক তরুণীকে। নাম তার রূপসা (উষসী রায়)। পরিচারিকা কাজ করতে এসে আবিষ্কার করে রূপসার মৃতদেহ। সে হইচই ক’রে লোক জড়ো করে। রূপসা একাই থাকত ওই ফ্ল্যাটে। সচরাচর এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়, তাকে ঘিরে যথেষ্ট নিন্দা-বিতর্ক ছিল। পেশায় সে উঠতি মডেল, সঙ্গে ছোটখাটো কিছু অভিনয়ের কাজও করত। যদিও রূপসার দামি আসবাবে সজ্জিত ফ্ল্যাট ও সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়িটি দেখে আশপাশের ফ্ল্যাটের সকলেই মনে করত, সামান্য অভিনয় বা মডেলিংয়ের কাজে এহেন বড়লোকি চাল সম্ভব নয়। অর্থাৎ, তার অন্যপথে রোজগার ছিল।

জি ফাইভ অরিজিনালস-এর নতুন ওয়েব সিরিজ ‘ছোটলোক‘-এর কাহিনি শুরু হয় এমনই নাটকীয় ঘনঘটায়। ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী পরিচালিত প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘ছোটলোক‘-এর পরিকল্পনা ও পরিবেশনায় এমন এক টানটান উত্তেজনার মোচড় রয়েছে যে দর্শক প্রথম পর্ব থেকেই পুরোপুরি কাহিনির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যান। বলতে দ্বিধা করব না, এই প্রতিবেদকের ক্ষেত্রেও অভিজ্ঞতা এমনই। ইন্দ্রনীলের কাছে অবশ্য এটাই প্রত্যাশিত ছিল। ‘ফড়িং‘, ‘মায়ার জঞ্জাল‘-এর মতো ছবির পরিচালকের কাছে এমন রিয়ালিস্টিক কাজই তো পাবেন দর্শক ! ‘ছোটলোক‘ তাই সচরাচর ওয়েব পর্দায় আমরা যা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি এখন, তার থেকে অনেকটাই আলাদা।

আমরা দেখি, খুনের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। এসআই সাবিত্রী মণ্ডল (দামিনী বেণী বসু) ও এএসআই জামিল শেখ (প্রতীক দত্ত) দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে, যা ছিল বেশ কঠিন। কেন না, ততক্ষণে রূপসার ফ্ল্যাটে বাকি ফ্ল্যাটের লোকজন অবাধে ঢুকে ধুন্দুমার কাণ্ড ঘটিয়েছে। সামনে ও আড়ালে যতই রূপসার চরিত্রহনন করার চেষ্টা করা হোক, তাকে নিয়ে আগ্রহও তো কিছু কম ছিল না ! ফিরে আসি সাবিত্রী মণ্ডলের কথায়। পুলিশের এই কর্মীটি দেখতে নেহাতই সাদামাটা হলেও, কাজে যে চরম দক্ষ, তা কাহিনির সামান্য পট পরিবর্তনেই বোঝা যায়। অভিনয়ে এককথায় চাবুক দামিনী ! সাবিত্রীর অনুসন্ধানের সূত্রেই উঠে আসে নানা তথ্য। রূপসার ফ্ল্যাটে নিয়মিত নানা পুরুষের যাতায়াত ছিল। একজন তার প্রাক্তন প্রেমিক সুমন। একদা সুমন ও রূপসা ছিল একই গ্রামের অধিবাসী। প্রেম পল্লবিত হয় কৈশোরেই। শহরে এসে বদলে যায় রূপসা। এখন সুমন তার কাছে ব্রাত্য। এই নিয়ে নিত্য অশান্তি, যা প্রায়ই মারদাঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছয় !

তবে, সুমন নয়, সাবিত্রীর রাডারে এখন রাজা। এলাকার জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা মোহর ভট্টাচার্যের (ইন্দ্রানী হালদার) ছেলে রাজা ভট্টাচার্য (গৌরব চক্রবর্তী)। স্ত্রী মল্লিকার (প্রিয়াঙ্কা সরকার) অফিস সহকর্মী রূপসার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে রাজা। রাজার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ শারীরিক সম্পর্কের ছবি-ভিডিও দেখিয়ে রাজাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে রূপসা। দাবি বিশাল অঙ্কের টাকা। মুখ বাঁচাতে যে রাতে টাকা দিতে আসে রাজা, সেই রাতেই খুন হয় রূপসা। এইসবই উঠে আসে সাবিত্রীর তদন্তে। এও জানা যায়, এর আগেও দুবার এই ব্ল্যাকমেইল মামলার কারণে পুলিশের মুখোমুখি হয়েছে রূপসা। এদিকে রাজা পুলিশের হেফাজতে যাওয়ার অর্থ, তার মায়ের রাজনৈতিক কেরিয়ারে ধাক্কা। আর এখান থেকেই রাজনীতির একটা সূক্ষ ছায়া-বিস্তার আমরা লক্ষ্য করি খুন, যৌনতা, বিশ্বাসহীনতার সমান্তরালে।

বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে রাজা, স্ত্রী মল্লিকার প্রতি। মল্লিকা সন্তানসম্ভবা। অথচ তাদের দাম্পত্য চরম শীতলতায় পর্যবসিত। সে রাজার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ চায়। মল্লিকা শুরু থেকেই মোহরের না-পসন্দ। ছেলের অসততা দেখেও দেখেন না তিনি। রাজাকে বাঁচাতে, নাকি নিজের রাজনৈতিক উত্থানের পথের কাঁটা সরাতে কোন পথ অবলম্বন করবেন জননেত্রী মোহর ভট্টাচার্য ? এক্ষেত্রে কী হবে তাঁর সমীকরণ ? ইন্দ্রানী হালদারের অভিনয়ে রক্তমাংসের এক মানুষ হয়ে ওঠেন মোহর। এদেশে রাজনীতি যে পথে, চালিত হয়, তাতে আর যাই হোক, নৈতিকতা খোঁজা বোকামি। সেই ধূসরতা বেশ দক্ষতার সঙ্গেই প্রকাশ করেছেন ইন্দ্রানী।

ইন্দ্রানী ও দামিনীর পাশাপাশি চরিত্রের মাপে নিখুঁত হয়ে উঠেছেন গৌরব, প্রিয়াঙ্কা, উষসী, প্রতীক প্রমুখ। আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সাবিত্রীর স্বামী রুদ্র (শুভ্রজিৎ দত্ত), কস্তুরী গুহ (উষসী চক্রবর্তী), তন্ময় বাগচী (দেবেশ চ্যাটার্জি), ফারুক (লোকনাথ দে), আদিত্য (জয়দীপ মুখার্জি), বাসু (জিৎ সুন্দর চক্রবর্তী) প্রমুখ সিরিজের কাহিনির এক একটি পর্যায়কে নাটকীয় অভিঘাতে ভরে তুলবেন। রূপসার খুনকে কেন্দ্র করে কোন কোন ভদ্রলোকের মুখোশ খুলবে আর তথাকথিত ছোটলোক-ভদ্রলোকের মাঝখানের বিভেদটাই যাবে ঘুচে, দেখুন এই সিরিজে। স্ট্রিমিং শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই।