Saturday, May 18, 2024
টলিউডলাইম-Light

ভালো সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে ক্রমশ

নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও উত্তরবঙ্গের সৃজনশীল তরুণ প্রজন্ম কাজ করে চলেছেন। সিনেমা বা বিনোদনের অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁদের সৃষ্টির ঐকান্তিক আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। এক্ষেত্রে কেউ কেউ সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছেও যাচ্ছেন। এমনই দুই মানুষ অভিজিৎ শ্রীদাস (পরিচালক) ও সুজিত কুমার রাহা (প্রযোজক)। এঁদের প্রথমজন বয়সে, পরের জন মনে তরুণ। বলা বাহুল্য, দুজনের সেই তারুণ্যের সুর যখন একত্রে মেতে ওঠে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে, তখনই তৈরি হয় ‘বিজয়ার পরে‘র মতো ছবি। পরিচালক হিসেবে অভিজিতের ডেবিউ ছবি ‘বিজয়ার পরে‘ (Autumn files) এই মুহূর্তে খবরের শিরোনামে। প্রযোজনা সংস্থা এসআর জুপিটার মোশন পিকচার্স। স্বাধীন বাংলা ছবি ‘বিজয়ার পরে‘র ২৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বেঙ্গলি প্যানারোমা সেকশনে অফিসিয়াল সিলেকশন নিঃসন্দেহে গর্বিত করে আমাদের। 

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, স্বাধীন বাংলা ছবি হয়েও মেনস্ট্রিম সিনেমার (বিশাল অঙ্কের বাজেট নিয়ে যারা ময়দান কাঁপাচ্ছে) সঙ্গে সমান তালে টক্কর দিচ্ছে এই ছবি। এই লড়াইয়ের বিষয়টি আলাদা করে বলতে চাই, কারণ, বিষয়টি শুধু একটা ছবি নির্মাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। উত্তরবঙ্গে ছবি তৈরির যে পরিকাঠামো, তাতে এই লড়াই প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করা। পরের প্রজন্ম তো এভাবেই অনুপ্রাণিত হয়। আর অর্থের অশোভন প্রদর্শন না করেও যে ভালো ছবি বানানো যায়, এই বিশ্বাস ফিরে পেয়ে, মন ভালো হয়ে যায় আমাদের মতো সিনেমা সাংবাদিকদের। 

‘বিজয়ার পরে‘র বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন মমতা শঙ্কর, দীপঙ্কর দে, স্বস্তিকা মুখার্জি, মীর আফসর আলি, ঋতব্রত মুখার্জি, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, অনিমেষ ভাদুড়ি, মিসকা হালিম, খেয়া চট্টোপাধ্যায়, তনিকা বসু, বিমল গিরি, সম্প্রীতি ঘটক প্রমুখ। প্রথম ছবিতেই অসাধারণ একদল অভিনেতার সম্মেলন ঘটিয়েছেন অভিজিৎ, যা অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। ছবির গল্প ও চিত্রনাট্য লিখেছেন অভিজিৎ নিজেই। কার্যনির্বাহী প্রযোজক প্রসেনজিৎ সিকদার ও অগ্নিশ্বর বসু। ডিওপি সুপ্রিয় দত্ত। সম্পাদনা অনির্বাণ নন্দী। শিল্প নির্দেশনা রণজিৎ ঘরাই। সঙ্গীত পরিচালনা ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর রনজয় ভট্টাচার্য। প্লেব্যাকে আছেন লগ্নজিতা চক্রবর্তী, ঈশান মিত্র, রনজয় ভট্টাচার্য, শাওনি মজুমদার। সাউন্ড ডিজাইনিং অয়ন ভট্টাচার্য ও অভীক চ্যাটার্জি। কস্টিউম সন্দীপ জয়সওয়াল ও অভিষেক রায়। মেকআপ প্রসেনজিৎ ব্যানার্জি। কালারিস্ট প্রসেনজিৎ ব্যানার্জি।

ছবির নামেই উপলব্ধ, এ কাহিনি দুর্গাপুজোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাঙালি জীবনে এই পুজোর যে মাহাত্ম্য, তা কোনও দিনই ধর্মের বেড়াজালে সীমাবদ্ধ নয়। নিজের প্রথম ছবি ‘বিজয়ার পরে‘তে সেই রূপের অতীত অরূপের সন্ধান দেবেন অভিজিৎ। বাংলার ঘরে ঘরে পারিবারিক বন্ধনের গভীর সুরটি প্রতি বছর বেজে ওঠে দুর্গাপুজোর প্রেক্ষাপটে পুনর্মিলনের সূত্র ধরে। উৎসব উদযাপন তো আছে, থাকবে। আনন্দময়ীর আরাধনায় আমরা আসলে ঘরে ফিরি। আপনজনের সান্নিধ্যে আশ্রিত হই। এই আশ্রয় আমাদের শান্তি ও আরামের প্রলেপ দেয়। শোক-দুঃখ-বেদনা ভুলে যেতে সাহায্য করে। এমনকী মৃত্যুও যেন হেরে যায় এই ভালোবাসার দুর্গের দরজায় এসে। 

এমনকী প্রজন্মের পার্থক্যও এই অনুভবের অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে না। দুর্গাপুজোর রঙিন চালচিত্রটি যেন মূর্ত হয়ে ওঠে চিরন্তন পারিবারিক কাঠামোর বৈচিত্র্য ও বৈভবে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির তর্ক ছাড়িয়ে আমাদের কাছে বড় হয়ে ওঠে, স্মৃতির নানা রঙ ! বারবার আমরা ফিরে যেতে চাই ফেলে আসা দিনগুলির কাছে। হৃদয়স্পর্শী একটি গল্প যে আমরা এই ছবির মাধ্যমে পর্দায় দেখতে চলেছি, এমন প্রত্যাশা করা যেতেই পারে। এখানে, একটা কথা বলতেই হবে, দুর্গাপুজোকে পটভূমি করে এর আগেও ছবি বানিয়েছেন, বাংলা ছবির পরিচালকরা। ‘বিজয়ার পরে‘র কাহিনি জানা না গেলেও, পরিচালক অভিজিৎ শ্রীদাসের পক্ষ থেকে যতটুকু ভাবনার সূত্র পাওয়া গিয়েছে, তাতে মনে হয় এই ছবিতে আমরা ব্যতিক্রমী, গভীর ও অর্থবহ কিছু দেখতে পাবো।

পরিচালকের কথায়, বাঙালি জীবনে দুর্গাপুজোর বহুমাত্রিকতা সর্বজনবিদিত। শক্তিকে আরাধনার এই যে চিরন্তন রীতি, সেখানে আগমনী থেকে বিজয়া আসে জীবনের উৎসব উদযাপনে। বাঙালির দুর্গাপূজা যেমন এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের গল্প বলে, তেমন ভাবেই আমাদের ছবিতে দর্শক পরতে পরতে খুঁজে পাবেন চিরায়ত বিশ্বাস ও ভরসার কাহিনি। না বলা অনেক কথা বলা হবে, শুধু চরিত্রদের অনুভবের অনুরণনে। ছবির অলকা, আনন্দ ও মৃন্ময়ী এবং অন্যান্য আরও মানুষের ভাবাবেগের নিবিষ্ট সঙ্গী হবেন দর্শক। প্রাচীন ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ নতুন সময়ের আলোয় উদ্ভাসিত হবে দুর্গাপুজোর ক্যানভাসে। 

শুরুতে যে কথা বলেছি, কঠিন হার্ডলসগুলি অতিক্রম করে কীভাবে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে পৌঁছে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের তরুণ প্রজন্ম। ছবির পরিচালক অভিজিৎ শ্রীদাস নিজেকে প্রস্তুত করেছেন সিনেমা তৈরির সবগুলি বিভাগের প্রেক্ষিতে। তাঁর দীর্ঘ বিজ্ঞাপন জগতের কাজ, রেডিও ও থিয়েটার-যাত্রার যে অভিজ্ঞতা–সব নিয়েই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন অভিজিৎ। অন্যদিকে, প্রযোজক হিসেবে সুজিত রাহা শুরু থেকেই উপহার দিতে চেয়েছেন একটি অর্থবহ ছবি। সামাজিক নানা ক্ষেত্রে সুজিতের অবদান বুঝিয়ে দেয় জীবন ও সমাজকে ঘিরে তাঁর সংবেদনশীল ভাবনাকে। স্পর্শকাতরতা ছাড়া মানবিক ছবিতে অর্থ লগ্নি করা সম্ভব নয়। এই দুই তরুণ ও তাঁদের টিম ‘বিজয়ার পরে‘কে যে বড় যত্ন ও বিশ্বাসের সঙ্গে বানিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কলকাতা ফিল্ম উৎসবের পাশাপাশি ২২তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও স্থান পেয়েছে ‘বিজয়ার পরে‘। উৎসবের ওয়ার্ল্ড সিনেমা বিভাগে দেখানো হবে ছবিটি। আরও বেশ কিছু উৎসবে স্থান পেতে চলেছে এই ছবি। আমাদের অপেক্ষা অবশ্য এর বাণিজ্যিক মুক্তির। সাধারণ দর্শক এ ছবিকে ভালোবাসবেই, এই বিশ্বাস ভাঙবে না জানি।