Saturday, May 18, 2024
টলিউডলাইম-Light

অর্থনৈতিক পিরামিডের নিচের দিকে থাকা মানুষদের নিয়েই ছবি বানাতে চাই

‘দোস্তজি’ নির্মাণের অনুপ্রেরণা–

সত্যি কথা বলতে কী, নির্দিষ্ট করে বলা খুব মুশকিল। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই ঘটেছে, যা ঘটার। ধর্ম আর রাজনীতি আজ মিলেমিশে একাকার, আর তার থেকেই একটা ভয়াবহ সামাজিক মেরুকরণ ঘটতে দেখছি আমরা সর্বত্র। ‘দোস্তজি’র গল্প আমি লিখেছি ২০১৪ সালে। যদিও আজও বিষয়টি যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক ! বলা ভালো, প্রাসঙ্গিকতা বেড়েছে।

সাফল্য প্রাপ্তির পথ ধরে যে অনুভূতি কাজ করে–

অনুভূতিটা আমি দুটি পর্বে ভাগ করে বলব। শুরুতে একটা উত্তেজনা নিশ্চয়ই ছিল। লন্ডনের টেমসের তীরে সাউথ ব্যাংকে যখন ‘দোস্তজি’র ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হচ্ছে, আর সেখানে একই সঙ্গে ড্যানিয়েল ক্রেগের ‘No time to die‘-এরও প্রিমিয়ার–সেটা তো নিঃসন্দেহে এক বিরাট রোমাঞ্চকর অনুভূতি দেয়। আরও ভালো লাগে যখন মনে পড়ে, আজ থেকে ৬৪ বছর আগে এখানেই সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার‘-এর প্রিমিয়ারও হয়েছিল !

কিন্তু একটা সময়ের পর আর বিষয়গুলো নাড়া দেয় না। ওই পুরষ্কার পেলে বা বড় কোনও উৎসবে প্রদর্শিত হলে, একটা তাৎক্ষণিক আনন্দ। এটা ঠিক, এই সব ঘটনাতেই আমার টিম খুব আনন্দিত এবং উজ্জীবিত হয়েছে। তবে, এরই পাশাপাশি অনেকদিন পর আবারও একটা বেশ আবেগাপ্লুত হওয়ার মতো অনুভূতি হলো, নিজের দেশে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর। আম জনতার পক্ষ থেকে যে অভাবনীয় সাড়াটা পেলাম, সেটা নিশ্চয়ই অসাধারণ এক প্রাপ্তি।

আমাকে সবচেয়ে বেশি যেটা স্পর্শ করেছে–একই সঙ্গে সমালোচকদের প্রশংসা ও স্বীকৃতি এবং সাধারণ সিনেমা দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা। তবে, সাফল্যকে সেভাবে গুরুত্ব দিতে রাজি নই আমি। সাফল্যকে সামলানোর সব থেকে সহজ উপায় হল সাফল্যকে উপেক্ষা করা, নিরাসক্ত থাকা।

‘দোস্তজি’র পরের পরিকল্পনা, তার উৎস ও গবেষণা–

এখনও বলার মত তেমন কিছু নেই। আমি প্রতি বছর একটা করে সিনেমা বানাব না। আমাকে প্রচুর টাকা দিলেও আমি ছ’মাসে একটা সিনেমা যেমন-তেমন করে বানাতে পারব না। এই মুহূর্তে বিরাট এক ক্যানভাসে রিসার্চের কাজটা চলছে। পটভূমি পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরবঙ্গ ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু অঞ্চলকে ঘিরে। যদিও, এখনও বলার মতো কিছু দানা বাঁধেনি। 

‘দোস্তজি’ আদ্যন্ত রিয়ালিস্টিক ছবি। প্রকাশভঙ্গি সরল ও সরাসরি। এটাই কী তোমার সিগনেচার স্টাইল থাকবে, না, বিষয় বদলালে, সেখানে পরিবর্তন ঘটবে ?

বিষয়ের দাবিতে ছবির ভাষা বা অভিব্যক্তি বদলাতেই পারে। যেমন ধরুন, ‘দোস্তজি’-তে কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছিল না। আমার অন্য ছবিতে প্রয়োজনে সেটা থাকলেও থাকতে পারে। সিগনেচার বলে আলাদা কিছু সেভাবে আমি মাথায় রাখতে চাই না। কিন্তু চেতনে বা অবচেতনে আমি যা, আমি তাই। আমার যে মৌলিক সত্ত্বা, সেখানে তো আমি নিজেকে বদলাতে পারব না ! সহজ কথা সহজ করেই বলব।

‘দোস্তজি’ দেখে একটা কথা খুব মনে হয়েছে, তুমি সিনেমায় যেটা বলতে চাও, সেটা একেবারে চিত্রনাট্য স্তরেই জলের মতো স্বচ্ছ ছিল তোমার কাছে। এটা কী সহজাত না এরজন্য কোনও প্রশিক্ষণ/পড়াশোনা/পূর্ব প্রস্তুতির প্রক্রিয়া ছিল ?

প্রথমেই বলি, আমি কোথাও কোনও প্রশিক্ষণ নিইনি। কোনও দিন কারোর সহকারী হিসেবেও কাজ করিনি। বলতে পারেন, পুরোটাই নিজের মতো করে শেখা। এটা একেবারেই ঠিক–আমার কাছে শুরু থেকেই ধারণাটা খুব পরিষ্কার ছিল। এমনকী অডিও স্তর পর্যন্ত ! ‘দোস্তজি’র sound design আমি নিজেই করেছি। আমার বানানোর যে ধরন, তাতে গোটা ছবিটা আমি শুটিং শুরুর আগেই খাতাকলমে বানিয়ে ফেলেছি। আমি ল্যাপটপে স্ক্রিপ্ট লিখতে অভ্যস্ত নই। শুনে আশ্চর্য লাগতে পারে, আমার বাড়িতে ১০/১২ কেজি নোটবই তো পাওয়া যাবেই ! ‘দোস্তজি’ তৈরির সমস্ত খুঁটিনাটি সেখানে লেখা আছে। নেহাত শেষ মুহূর্তে কিছু জরুরি পরিবর্তন ছাড়া, বাকি ওই পূর্ব নির্ধারিত ভাবনা ও পরিকল্পনা অনুসারেই ঘটেছে।

‘দোস্তজি’ দর্শকের প্রত্যাশার মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা কতটা আত্মবিশ্বাস বাড়ায় আর কতটা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে ?

কোনও বাড়তি চাপ নেই। আত্মবিশ্বাস অবশ্যই কিছুটা বেড়েছে, বলতে পারি। আমি যদি এটাকে সাফল্য হিসেবে ধরেওনি, একে ধরে রাখার ক্ষেত্রে আমার নিজের কোনও দায় নেই। আমি আমার মতো করে ছবি বানাতে চাই, যতদূর সম্ভব নিজের কাছে সৎ থেকে। আমার টিমও তাই করবে। আমার চাহিদাও কম। সত্যি কথা বলতে কী, আমি ইএমআই দেওয়ার জন্য সিনেমা বানাতে চাই না। হয়তো আমি একটা গাড়ি কিনতে পারি। কিন্তু, এখনও কোনও প্রয়োজন দেখি না তার। আমি মেট্রো রেল, বাস, অটোতেই যাতায়াত করতে স্বচ্ছন্দ। কারণ, আমার কাছে মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত থাকাটা খুব গুরত্বপূর্ণ। ওই কাচ-ঢাকা গাড়িতে যেটা মোটেই সম্ভব নয়।

ভারতীয় সিনেমায় ধর্মীয় মেরুকরণ সমাজের পক্ষে চরম অভিশাপের কারণ বলে মনে করছেন অনেকেই। এ প্রসঙ্গে তোমার মতামত জানাও।

দেখুন, সিনেমা তো সমাজের বাইরে নয়। যেটা সমাজে ঘটছে, সেটাই সিনেমাতেও এসে যাচ্ছে। এটা তো মারাত্মক ক্ষতিকারক বটেই। ভয়াবহ একটা পরিস্থিতি। এটা আমি আর আলাদা করে কী বলব ! এটা এখন সকলেই বুঝতে পারছেন, বলছেনও। এটা নিয়ে যাই বলি, কম বলা হবে।

আগামী দিনে কোন কোন বিষয়কে আমরা তোমার সৃষ্টির মাধ্যমে দেখতে পাবো ?

সেভাবে নির্দিষ্ট কিছু নেই। আমি আগে থেকে ওইভাবে গল্প লিখে রাখি না। ওই one liner মতো তৈরি থাকে। ১০/১২ টা বিষয় ভাবনায় রয়েছে। তার মধ্যে খান ৩/৪টে হয়তো short listed হবে। সেগুলোই ধাপে ধাপে আসবে। আগামী দুটো ছবি বানাতেই তো আমার ৫/৬ বছর লেগে যাবে। আমার সব ছবির বিষয়বস্তুই মূলত পৃথিবীর অর্থনৈতিক পিরামিডের নিচের দিকে থাকা মানুষদের নিয়ে হবে। যে কারণে সায়েন্স ফিকশন হয়ত বানাতে পারব না আমি কোনওদিন। যাই হোক, একটা ছবি বানিয়েই অনেক বড় বড় কথা বলে ফেললাম, এটাকে ঔদ্ধত্য হিসেবে দেখবেন না প্লিজ!