Sunday, May 19, 2024
বলিউডলাইম-Light

করণ আছেন করণেই

নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। ভারতীয় সিনেমা দর্শকের দেখা বদলে গেছে, কিন্তু, করণ জোহর বদলাননি! লিখেছেন চন্দন রায়

গত সাত বছরে কত বদলে গেছে দুনিয়া ! বদলে গেছে সিনেমার ভাষা। কিন্তু, সাত বছর পর নতুন ছবি পরিচালনা করতে এসে করণ জোহর হাঁটলেন তাঁর কমফোর্ট জোনেই। প্রমাণ করে দিলেন, তিনি আছেন তাঁর কল্পনার পারিবারিক জগতেই–যে পরিবারগুলো বাস্তবে আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না! অথচ, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। প্রযোজক হিসেবে তো করণ জোহর বিগত প্রায় এক দশকে নানান স্বাদের ছবি উপহার দিয়েছেন আমাদের ! বহু পরিচালকের নিত্যনতুন ভাবনাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন! কিন্তু নিজে পরিচালনায় হাত দিয়ে কেন সেই স্টিরিওটাইপেই ফিরে গেলেন? নাকি এটাই পরিচালক করণের ইউএসপি? তাই সেখান থেকে সরে আসতে তিনি ভয় পান!

পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে করণ জোহরের পরিচালনায় সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রকি অউর রানি কি প্রেম কহানি’ ছবিটির পরিপ্রেক্ষিতেই কথাগুলো উঠে এল! না, এটা কিন্তু ছবির তথাকথিত রিভিউ নয়। বলা যায়, আজকের ভারতীয় সিনেমার প্রেক্ষাপটে একটু ভিন্নধারার বিশ্লেষণ ! এক্ষেত্রে শুরুতেই যেটা বলব, প্রায় এক দশকের ব্যবধানে যখন বলিউড তথা গোটা বিশ্বেরই বিনোদনের সংজ্ঞা বদলে গেছে, তখনও পরিচালক করণ জোহর যেন সেই বদলের খবর সম্পর্কে অনবহিত! সেই কারণে তিনি এমন একটা ছবি উপহার দিলেন এতদিনের ব্যবধানে, যেখানে, নতুন কিছু পাওয়া গেল না, সামান্য কয়েকটি স্ফুলিঙ্গ ছাড়া।

করণ জোহর পরিচালক হিসেবে বলিউডে পা রেখেছিলেন নয়ের দশকের শেষ ভাগে। খ্যাতনামা  প্রযোজক যশ জোহরের ছেলে তথা বিখ্যাত প্রযোজক ও পরিচালক যশ চোপড়ার ভাগনে করণ কিন্তু নিজের শৈলীতেই বলিউডে ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন শুরুতেই! শাহরুখ, কাজল আর রানি মুখার্জিকে নিয়ে তাঁর প্রথম ছবি ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ তীব্র অনুরণন তুলেছিল সেই সময়ের নতুন প্রজন্মের মনে! জনপ্রিয় সিনেমার জাতীয় পুরষ্কারও জুটে গিয়েছিল সেই ১৯৯৮-তেই! করণ নিজে পেয়েছিলেন সেরা পরিচালকের ফিল্মফেয়ার!

পরবর্তীতে পারিবারিক মূল্যবোধকে মূলধন করে একাধিক ছবি করেছেন পরিচালক করণ। সেগুলিও তৃপ্ত করেছে দর্শক এবং সমালোচক দু’পক্ষকেই। উদাহরণ, ‘কভি খুশি কভি গম’ বা ‘কভি অলবিদা না কহে না’। নিজের চেনা ছক থেকে খানিকটা সরে এসে ২০১০-এ শাহরুখ খানকে নিয়ে করণ উপহার দিয়েছিলেন ‘মাই নেম ইজ খান’ ছবিটি। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দারুণ এক সামাজিক বার্তা তুলে ধরেছিল সেই ছবি। শাহরুখের কন্ঠে সেই ছবির সংলাপ ‘মাই নেম ইজ খান অ্যান্ড আই অ্যাম নট আ টেররিস্ট’ মন ছুঁয়ে গিয়েছিল সকলেরই!

আজ আর সেই করণ জোহরকে পাওয়া গেল না তাঁর নতুন ছবিতে! নতুন ছবিতে না সেভাবে জমাতে পারলেন রকি আর রানির প্রেম, না, তুলে ধরতে পারলেন নতুন কোনও পারিবারিক রসায়ন! শ্যাম রাখি না কূল রাখি–করণের দশা হয়েছে অনেকটা সেইরকম! তিনি বুঝতে পারছিলেন পারিবারিক নাটক আর প্রেমের যে ধরণের গল্প সিনেমার পর্দায় তিনি বলতে অভ্যস্ত, সেগুলো এখনকার দর্শক আর নয়ের দশকের মতো গোগ্রাসে গিলবে না। তাই চেষ্টা ছিল, তার মধ্যেই কিছু সামাজিক বার্তার মিশ্রণ তুলে ধরা। কিন্তু তাতে সব মিলিয়ে যে খিচুড়িটি তিনি পেশ করেছেন, সেটা কোনও পক্ষকেই খুশি করতে পারেনি। 

আর এর প্রমাণ মিলেছে বক্স অফিসেই! করণ জোহরের পরিচালনায় নতুন ছবি মুক্তি পেল সাত বছর পর, অথচ, বক্স-অফিসে প্রথম দিনের কালেকশন মাত্র ১২ কোটি! আজকের বলিউডের ব্যাবসার নিরিখে যা প্রায় কিছুই না! এখন তো ওপেনিং কালেকশনই বলে দেয় ছবি কতদূর যাবে! প্রশ্ন উঠছে, যেখানে একই সঙ্গে মুক্তি পাওয়া হলিউডের ‘ওপেনহাইমার’ রমরমিয়ে চলছে, সেখানে ‘রকি অউর রানি কি প্রেম কহানি’ দেখতে দর্শকের মধ্যে ততটা উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না কেন? প্রসঙ্গত, তথাকথিত বিনোদনের লেশমাত্র নেই ‘ওপেনহাইমার’-এ। এটি আদ্যন্ত একটি সিরিয়াস ছবি।

পাঞ্জাবি ছেলে রকি আর বাঙালি মেয়ে রানির প্রেমের গল্প বলতে গিয়ে অবধারিত ভাবেই চলে এসেছে দুই পরিবারের পৃথক সংস্কৃতির গল্প। কিন্তু সেখানেও স্টিরিও-টাইপকে ভাঙতে পারলেন কই করণ? একদা করণের হাতেই তৈরি ‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার’ আলিয়া ভাট তো এখন অভিনয়ের গুণেই সমাদৃত। তাহলে তাকে কেন শরীরী আকর্ষণে দর্শক টানতে হবে? তার মুখের ভাঙা বাংলা বাঙালিকে খুশি করতে পারল কি? রণবীর সিং তার এনার্জি লেভেল নিয়ে দারুণ অভিনয় করে গেছেন। কিন্তু পাঞ্জাবি পরিবারের স্টিরিও টাইপ ব্যাপারটি সম্ভবত প্রকৃত পাঞ্জাবিদেরও তেমন আনন্দ দিতে পারছে না ইদানীং। ফলস্বরূপ প্রত্যাশিত মাত্রায় দর্শক উপছে পড়ল না প্রেক্ষাগৃহে।

আর এই ছবির গান? একটি ছাড়া একেবারেই মনে দাগ কাটছে না! করণের ফিল্মি কেরিয়ারের বেশিরভাগ ছবির গানই তো দর্শক-শ্রোতাদের মুখে মুখে ঘুরেছে দশক পার করেও! সেই সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা কেন পাওয়া গেল না নতুন ছবিতে? বরং জনপ্রিয় পুরোনো গানগুলিই মাতিয়ে রাখল দর্শক-শ্রোতাদের। এটাও ভীষণ একটা ব্যর্থতা! সার্বিকভাবে যেটা বলার, কোভিড পরবর্তী সময় থেকেই দর্শকদের ছবি দেখার চোখটা বদলে গেছে। ওটিটি-র কল্যাণে দুনিয়ার প্রায় সব বিনোদন এখন তাদের হাতের মুঠোয়। সেখানে তাদের সিনেমাহলে টেনে আনতে পারার জন্য চাই নতুন কিছু। আর সেটাই সবচেয়ে কঠিন  চ্যালেঞ্জ! এই ছবিতে প্রাপ্তি বলতে ধর্মেন্দ্র, শাবানা আজমি, জয়া বচ্চন, টোটা রায়চৌধুরি আর চূর্ণী গাঙ্গুলির মতো দক্ষ শিল্পীদের অভিনয়। দক্ষতার সঙ্গে ছবির অনেক দুর্বলতাকেই ঢেকে দিতে সফল হয়েছেন তাঁরা। তবু, শেষমেশ হাতে রয়ে যায় পেন্সিল! কোথাও যেন মনের গহীনে হিসাব চলতে থাকে, নতুন সময়ে দাঁড়িয়ে করণের থেকে নতুন কিছু পেলাম কী? আক্ষেপের সঙ্গে বলতেই হচ্ছে, কোথাও তো ‘কুছ কুছ’ হচ্ছে না!