Sunday, May 19, 2024
ওয়েব-Wave

তারকার ঘেরাটোপ ছেড়ে সুজয়ের থ্রিলারে করিনা

বেগমের ওটিটি ডেবিউ ‘জানে জান’ নেটফ্লিক্স-এ। টানটান রহস্য ঘনীভূত উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে। লিখেছেন মৃণালিনী ঠাকুর

মার্ডার মিস্ট্রির মতো টানটান টেনশনের সঙ্গে তথাকথিত রসকষহীন গণিতশাস্ত্রকে মিলিয়ে থ্রিলার নির্মাণ ভারতীয় বিনোদনে এর আগে কেউ করেছেন কিনা, আমার অন্তত জানা নেই। তবে, সুজয় ঘোষ করেছেন। নেটফ্লিক্স-এ স্ট্রিমিং হওয়া তাঁর সাম্প্রতিক থ্রিলার ‘জানে জান’ সংগত কারণেই তাই বহুল পরিমাণে আলোচনায়। কেইজো হিগাশিনোর লেখা ‘সাসপেক্ট এক্স’ অবলম্বনে ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন সুজয় স্বয়ং। ডায়ালগ রাজ বসন্ত। ২ ঘণ্টা ১৯ মিনিটের এই ছবি একটি মুহূর্তের জন্যও অন্যমনস্ক হতে দেয় না দর্শককে–এতটাই শক্ত বুনোটে বিন্যস্ত এর কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও প্রতিটি পর্যায়ের দৃশ্যায়ন !

থ্রিলার নির্মাণে সুজয়ের বিশেষ দক্ষতা প্রসঙ্গে সকলেই ওয়াকিবহাল। তা সত্ত্বেও পৃথকভাবে ‘জানে জান’-এর উল্লেখ করতে হয়। বড় পর্দার তুলনায় ওটিটি-তে রহস্যের জাল বিছানো শক্ত। সিনেমা হলে পুরো মনোযোগটাই থাকে পর্দায়। অন্দরে প্রতি মুহূর্তে মনোযোগ হারাবার আশঙ্কা থাকে, যা এক্ষেত্রে মোটেই ঘটে না। লোকেশন উত্তরবঙ্গের পাহাড়ী অঞ্চল। কাহিনিতে দার্জিলিং ও কালিম্পংয়ের উল্লেখ। দারুণ দৃষ্টিনন্দন এক পটভূমিতে গল্প বুনেছেন সুজয়। উত্তুঙ্গ প্রাচীন বৃক্ষরাজি, পথের কঠিন চড়াই-উৎরাই, প্যাঁচানো অলিগলি, ছড়ানো ছেটানো বাড়িঘর–আর সবকিছুর ওপর কুয়াশার এক ঘন আস্তরণ যেন গল্পের চরিত্রের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

একজন একা মা, তার কিশোরী কন্যাসহ বাস করে। দিন যাপন মায়ের ফুড কর্নারের ব্যবসায়। মেয়েটি স্কুলে পড়ে। মা-মেয়ের জীবনে আপাতত কোনও পুরুষ অভিভাবক নেই। ওই বাড়িতেই থাকে এক অঙ্কের মাষ্টারমশাই, যে কিনা তরুণী এই মায়ের প্রতি বেশ খানিকটা দুর্বল। বিপদে-আপদে মা-মেয়ের পাশে থাকে এলাকারই এক স্কুলের অঙ্কের এই মাস্টারমশাই। হঠাৎ করেই সেখানে হাজির হয় তরুণীর স্বামী, মেয়েটির বাবা, যে কিনা আচারে-ব্যবহারে আপাদমস্তক এক ক্রিমিনাল। লোকটি তরুণীর অতীত ইতিহাসের দোহাই দিয়ে, তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে। তারপরই এমন কিছু ঘটে যায়, যার ফলে বদলে যায় সংশ্লিষ্ট সবকটি মানুষের জীবন।

থ্রিলারের গল্প আগাম জেনে গেলে, সিনেমা দেখার মজাই নষ্ট। তাই গল্পের রেশটুকু রেখে, অন্য প্রসঙ্গে যাই। সুজয় ঘোষের লেখন ও পরিচালনা যদি এ ছবির মুখ্য উল্লেখ্য হয়, তবে, এই ছবি মূলত দাঁড়িয়ে অঙ্কের মাস্টারের (নরেন ব্যাস) ভূমিকায় জয়দীপ আহলাওয়াটের অভিনয়ে। জয়দীপ কোন মাপের অভিনেতা, সেই বিস্তারে না গিয়েও বলা যায়, এই চরিত্রটি যেন ওঁকে ভেবেই লেখা। প্রতিটি স্তরে, বিশেষত, যখন তিনি খুনের অপরাধী রূপে জেলখানার দেওয়ালে অঙ্ক কষছেন, জয়দীপ তাঁর অপরিহার্যতা প্রমাণ করেন। এরপরই আসে বিজয় বর্মার (ইন্সপেক্টর করণ আনন্দ) নাম। সাবলীল ও বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয়ে গল্পের গতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এগিয়ে চলেন তিনি। অন্যান্য ভূমিকায় চরিত্রের মাপে নিখুঁত সৌরভ সচদেব (অজিত মাত্রে), নাইশা খান্না ( তারা ডি’সুজা), কর্মা থাকাপা (সুন্দর সিং), লিন লাইশরাম (প্রেমা কামি) প্রমুখ।

লাস্ট নট দ্য লিস্ট, মিডিয়া জুড়ে এই ছবিকে ঘিরে প্রথমেই যে নামটি উঠে এসেছে, তিনি বলিউড সুপারস্টার বেগম করিনা কাপুর খান (মায়া ডি’সুজা), তাঁর কথা। ‘জানে জান’ করিনার ওটিটি ডেবিউ। বিচক্ষণ ও পরিণত করিনা পদক্ষেপে ভুল করেননি। এই ছবি যে তাঁকে তাঁর পড়তি কেরিয়ারে বিশাল এক মাইলেজ দিয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গ্ল্যামারের আবরণ ছিঁড়ে এক কিশোরীর মায়ের চরিত্রে অভিনয়ের সিদ্ধান্তের জন্য কুর্নিশ করতেই হবে করিনাকে। পাশাপাশি একথাও ঠিক, এই ছবিতে অভিনয় করা, বিশেষত, জয়দীপ ও করণের পাশে, তাঁর জন্য যথেষ্ট বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রতি মুহূর্তে করিনা যে সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছেন, তা ছবিতে পরিষ্কার। তবু, তাঁর এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।

যেমন ক্যানভাস, তেমনই সিনেমাটোগ্রাফি। অভীক মুখোপাধ্যায় বরাবরের মতোই অতুলনীয় কাজের স্বাক্ষর রাখেন। তাঁর ক্যামেরা পাহাড়ী অঞ্চলের স্বাভাবিক আলো-আঁধারিকে বাঙ্ময় করে তোলে। যোগ্য সাথী হয়ে ওঠে ক্লিনটন সেরেজো, বিয়াঙ্কা গোমস, শোর পুলিস ও শচীন-জিগরের মিউজিক। ছবিটি প্রযোজনা করেছেন সুজয় ঘোষ, একতা কাপুর, শোভা কাপুর, আকাশ পুরি, জয় শেওয়াক্রমানি, হুনউ থমাস কিম, গৌরব বোস প্রমুখ ১০জন মিলে। যাঁরা থ্রিলার ভক্ত, তাঁরা তো বটেই– অন্যরাও বেশ উপভোগ করবেন নেটফ্লিক্স-এর ওটিটি ছবি ‘জানে জান’।