Saturday, May 18, 2024
কৃষ্টি-Culture

অনীক-এর গঙ্গা-যমুনা উৎসব

কলকাতার অনীক নাট্যদলের গঙ্গা-যমুনা উৎসব একটি ঐতিহ্যপূর্ণ নাট্যোৎসব। ১৯৯৮ সালে এই উৎসবের সূচনা। উল্লেখ্য, প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে এক সাংস্কৃতিক সেতু রচনা করেছে এই নাট্যোৎসব। দেশের সীমা ছাড়িয়ে প্রথম বাংলাদেশে এই উৎসব শুরু হয় ২০১২ সালে। প্রতিবছর অনীকের এই উদ্যোগ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সাংস্কৃতিক উৎসব নামে অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৩ হলো গঙ্গা-যমুনা উৎসবের রজতজয়ন্তী বর্ষ। ইতিপূর্বে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন আমন্ত্রিত নাট্যদল নিয়ে কলকাতায় এই উৎসব হতো। ২৫তম বর্ষে তাঁরা জেলায় জেলায় এই উৎসবকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এবছর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় অনীকের উদ্যোগ ও স্থানীয় নাট্যদলের ব্যবস্থাপনায় ২৬টি পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় উৎসব। ১০২ দিন ব্যাপী আয়োজিত এই উৎসবে মোট ২৮২টি নাট্যদলের প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়।

গঙ্গা-যমুনা উৎসবের ২৫তম বর্ষে ২৫তম নাট্যোৎসবটি ছিল হলদিবাড়ি পর্যায়। হলদিবাড়ি কোলাজ নাট্যদলের ব্যবস্থাপনায় ও সহযোগিতায় গত ১৭,১৮ ও ১৯ শে মার্চ–এই তিনদিনের উৎসবে হলদিবাড়ি রবীন্দ্রভবনে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি ও হলদিবাড়ি মিলিয়ে মোট ১১টি প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়। একটি বর্ণময় শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রবীণ নাট্যশিল্পী সমরেন্দ্র নারায়ণ দে এই উৎসবের সূচনা করেন। প্রথম সন্ধ্যায় নাট্যোৎসবের উদ্বোধন করেন সাহিত্যিক সত্যরঞ্জন রক্ষিত।

এদিনের প্রথম প্রযোজনা অরবিন্দ উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নির্মিত ও অভিনীত নাটক ‘ভাষা’। বাংলাভাষার অবনমনের প্রতি প্রতিবাদে মুখর ছিল ছাত্রছাত্রীদের পরিবেশিত এই নাটক। এর পরের প্রযোজনা শিলিগুড়ি বনমালা-র নাটক ‘চোর সংবাদ’ দর্শককে নির্মল আনন্দ দিয়েছে। এদিনের শেষ নাটক অনীক প্রযোজিত নাটক ‘ভালোবাসা’। মানবহৃদয়ের আবেগ ও বাস্তবতার মিশেলে এক অপূর্ব ভালোবাসার গল্প বুনেছেন নাট্যকার সুদীপ্ত ভৌমিক। আর তাতে প্রাণ সঞ্চার করেছেন নির্দেশক অরূপ রায়।

দ্বিতীয় দিনের প্রথম প্রযোজনা শিলিগুড়ির দামামা নাট্যদলের হিন্দি নাটক ‘আখরি ইনাম’। নাট্যকার ও নির্দেশক এই নাটকে আধুনিক যুগেও বর্ণবৈষম্যের এক করুণ পরিণতি তুলে ধরেছেন, যা দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করেছে। দ্বিতীয় দিনের তৃতীয় প্রযোজনা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ও পলক চক্রবর্তী নির্দেশিত শিলিগুড়ির উত্তাল নাট্যদলের নাটক ‘এক সন্ধ্যায়’। সংগীতমুখর এই নাটক দর্শকনন্দিত হয়েছে। এদিনের তৃতীয় নাটক জলপাইগুড়ি উজান প্রযোজিত ‘যুদ্ধসন্ধ্যায় একাকিনী’। চন্দন সেন রচিত ও ডালিয়া চৌধুরী নির্দেশিত এই নাটকে রাজনীতির আবহে আদর্শ ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কাহিনি উঠে এসেছে। এ নাটকটিও দর্শক প্রশংসিত। দ্বিতীয় সন্ধ্যার শেষ নাটক ‘এক যে আছে খুনি’, যার রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন শেখর মজুমদার ও মৌসুমী মজুমদার। ৩৪ ও ১২ বছরের দুটি স্বত্বার খুনি মাঝরাতে থানায় এসে রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত নাড়িয়ে দেয়। সেই প্রেক্ষাপটেই হাস্যরসের মোড়কে নির্মিত এই নাটকের কাহিনি ও সাবলীল অভিনয় দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছে।

উৎসবের শেষ দিনের প্রথম নাটক, জলপাইগুড়ি রূপায়ন প্রযোজিত, মোহিত চট্টোপাধায় রচিত ও দীপঙ্কর রায় নির্দেশিত নাটক ‘হীরামন’। রূপকধর্মী এই নাটকে, স্বৈরাচারী শাসকের শোষণযন্ত্রে নিপীড়িত মানুষ একসময় শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তার পতনকে অনিবার্য করে তোলে। এই নাটকটি দর্শকের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। দ্বিতীয় প্রযোজনা জলপাইগুড়ি অনুভব নাট্যসংস্থার ‘স্বপ্নের সারথী’। নাট্যকার স্বপন দাসের কলমে নির্দেশক সাধন চক্রবর্তীর নির্দেশনায় এই নাটকে এক ব্যর্থ নাট্যশিল্পীর স্বপ্ন, হতাশা ও পরিণতির কাহিনি বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে সাধন চক্রবর্তীর অনবদ্য অভিনয় দর্শকদের অভিভূত করেছে। এদিনের তৃতীয় নাটক দর্পণ নাট্যসংস্থা প্রযোজিত ‘তিনকন্যা’। কুন্তল মুখোপাধ্যায় রচিত ও তন্দ্রা চক্রবর্তী নির্দেশিত এই নাটকে সমাজের নানা স্তরের নারীর অবমাননা ও লাঞ্ছনার কাহিনি দর্শকের মন ছুঁয়ে গেছে। উৎসবের শেষ দিনের শেষে ছিল, হলদিবাড়ি কোলাজ প্রযোজিত ছোটদের নাটক ‘কুমন সুমন’। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের রচনায়, দীপঙ্কর মন্ডলের নির্দেশনা ও হিরণ্যদ্যুতি রায়ের সহ-নির্দেশনায় এই নাটকে একঝাঁক কচিকাঁচার অসাধারণ অভিনয় দর্শকদের অভিভূত করেছে। তিনদিনের অনীক গঙ্গা-যমুনা উৎসবকে সর্বাঙ্গীনভাবে সফল করে তোলার জন্য হলদিবাড়ি কোলাজ নাট্যদলের সক্রিয় সহযোগ অত্যন্ত প্রশংসার দাবি রাখে। অনীকের এমন আয়োজন আগামী দিনেও থিয়েটারের হাত ধরে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ও সম্প্রীতির পথে আলো দেখাবে এই আশা রাখা যায়।